মিশ্র অর্থনীতি কি? সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশভেদে ভিন্নতা পরিলক্ষতা দেখা যায়। পৃথিবীর দুই শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে, যার নাম মিশ্র অর্থনীতি। মিশ্র অর্থনীতি বলতে পুঁজিবাদি বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সংমিশ্রণকে বোঝায়। এ অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় অর্থনীতির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
মিশ্র অর্থনীতিতে একদিকে যেমন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ন্যায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে তেমনি অন্যদিকে, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির ন্যায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রয়েছে। এছাড়া এই ব্যবস্থায় সরকার ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে উৎপাদন ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, বাংলাদেশ, ভারত এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে মিশ্র অর্থনীতি চালু রয়েছে।

মিশ্র অর্থনীতির সংজ্ঞা

মিশ্র অর্থনীতি (Mixed economy) এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। অর্থাৎ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো পরিত্যাগ করে এবং ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে গড়ে ওঠে, তাকে মিশ্র অর্থনীতি বলে।
অর্থনীতিবিদ র‌্যাগান এর মতে, ‘‘মিশ্র অর্থনীতি হল এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। কিছু সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় এবং কিছু সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। এছাড়া অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বাজার ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে।’’
স্যামুয়েলসন এবং নর্ডহাউসের মতে, “মিশ্র অর্থনীতি হল একটি অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া (সাধারণত সরকারি পরিষেবা, প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো এবং মৌলিক শিল্পে) উভয়ই সহাবস্থান করে।”
অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছেন, “মিশ্র অর্থনীতি বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে উৎপাদন ও ভোগ কার্য সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার সাথে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটেছে।”

মিশ্র অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়। যেমন,
১. ব্যক্তিগত মালিকানা ও উদ্যোগ : মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পত্তি ও উৎপাদনের উপকরণ সমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এই ব্যবস্থায়, ব্যক্তিগত মালিকানা ও উদ্যোগের স্বাধীনতা, ভোগকারীর সার্বভৌমত্ব ও স্বয়ংক্রিয় মূল্য ব্যবস্থা বজায় থাকে।
২. সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ: মিশ্র অর্থনীতিতে সম্পত্তি ও উৎপাদনের উপকরণ সমূহের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া হয়। দেশের মৌলিক ও ভারী শিল্প, জাতীয় নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকার পরিচালনা করে থাকে। সরকার আইন ও বিভিন্ন প্রবিধানের মাধ্যমে কর, ভর্তুকির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ করতে পারে।
৩. ভোক্তা সুরক্ষা ও স্বাধীনতা: সরকার পণ্যের নিরাপত্তা, ন্যায্য মূল্য এবং ন্যায্য ব্যবসায়িক অনুশীলন নিশ্চিত করে এমন আইন ও প্রবিধান প্রয়োগ করে ভোক্তাদের রক্ষা করে। এ ব্যবস্থায় ভোক্তা সাধারণ দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে পণ্যের দামের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুসারে কোনো দ্রব্যের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: মিশ্র অর্থনীতির লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণের প্রচার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা।
৫. স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা: মিশ্র অর্থনীতিতে স্বয়ংক্রিয় মূল্য ব্যবস্থার দ্বারা উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগ কার্যসম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে দ্রব্যের দাম তার চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত হয়। কিন্তু দাম ব্যবস্থা জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন কর আরোপ, সুদের হার হ্রাসবৃদ্ধি করে দাম প্রক্রিয়ার কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৬. যৌথ বিনিয়োগ: মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে যৌথভাবে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়। বেসরকারি (এনজিও) এবং সরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি বিরাজ করায় যৌথভাবে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়।
৭. মুনাফা অর্জন: মিশ্র অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়। তবে মুনাফার অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও সরকার জনস্বার্থে দাম ও মুনাফা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
৮. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: মিশ্র অর্থনীতিতে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যকলাপে সরকার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে কৃষি, শিল্প প্রভৃতি উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
৯. শ্রমিকের স্বার্থসংরক্ষণ: সরকার শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি ও কাজের সময় নির্ধারণ, শিল্প বিরোধের নিষ্পত্তি, ছুটি ইত্যাদি নির্ধারণ করে।

Similar Posts