১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই, পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতন ভোগ করতে থাকে।
৫৪’ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় ছিল বাঙালি কর্তৃক এক নিরব যুদ্ধ। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার মাত্র ৩ মাস স্থায়ী হয় কিন্তু এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিজয়।
এই আর্টিকেলে, আমরা যুক্তফ্রন্ট কি, যুক্তফ্রন্ট গঠন, ফলাফল ও ২১ দফা কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব।
যুক্তফ্রন্ট কি?
যুক্তফ্রন্ট হলো ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য বিরোধী দল মিলে গঠিত একটি সমন্বিত রাজনৈতিক মঞ্চ। সহজভাবে বলতে গেলে, যুক্তফ্রন্ট হলো ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য ৪টি বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগ (ভাসানী), কৃষক শ্রমিক পার্টি (এ কে ফজলুল হক), নেজামে ইসলাম পার্টি (মাওলানা আতাহার আলী), বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি (হাজী মোহাম্মদ দানেশ) ও পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল একসাথে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই জোটের মধ্যে একাধারে গণতন্ত্রপন্থী, মধ্যমপন্থী, বামপন্থী ও ইসলামীপন্থী মানসিকতার সমন্বয়ে গঠিত। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রতীক ছিল “নৌকা” এবং মুসলিম লীগের নির্বাচনী প্রতীক ছিল “হারিকেন”।
একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ২১ দফা কর্মসূচির প্রধান দাবি ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া, ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি।
যুক্তফ্রন্ট গঠন
যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অন্যায়, অত্যাচার ও বাঙালিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের অবসান ঘটানো। এছাড়া বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মহলানা আতহার আলী এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ এর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, ৪টি বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নিজাম-ই-ইসলামি এবং বামপন্থী গণতন্ত্রি দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রতীক ছিল।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল
১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ, পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে মোট আসন ছিল ৩০৯ টি। মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত ছিল ২৩৭ টি আসন এবং ৭২ টি আসন অমুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮ টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ১৯ টি, গণতন্ত্রী দল ১৩ টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪ টি ও পরে যোগ দেওয়া স্বতন্ত্র ৮ টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ৯টি আসন লাভ করে সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাজিত হয়।
অমুসলিমদের ৭২টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস লাভ করেছিল ২৪টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি, তফসিলি ফেডারেশন ২৭টি, গণতন্ত্রী দল ৩টি এবং ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি ১৩টি আসন লাভ করেছিল। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।
নির্বাচনের ফলাফল হিসেব করে দেখা যায়, যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২৩৬টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিপরীতে, সরকারি দল মুসলিম লীগ মাত্র ৯ টি আসন লাভ করে।
যুক্তফ্রন্ট সরকার
১৯৫৪ সালের ৩ রা এপ্রিল, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক ৪ সদস্য বিশিষ্ট যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৫ মে, মন্ত্রিসভায় আরো ১০ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ শাসনতন্ত্রের ৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন।