সরকারের সমস্যাবলী এবং এর প্রকৃতি
আধুনিক সরকারের সমস্যা ব্যাপক ও বহুমুখী। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। আর স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবর্তনের ধারা বয়ে এনেছে নতুন ধরনের সমস্যা। উপরন্তু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র একদিকে যেমন উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে অপরদিকে জনগণের জীবনযাত্রাও ততই সমস্যা সংকুল, প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও জটিল হয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্নমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
আধুনিক সরকারকে তাই এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হয় এবং একই সঙ্গে এসবের যথাযথ সমাধানের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। মূলতঃ এসব সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে সরকারের সফলতা এবং স্থায়িত্ব।
নিম্নে সরকারের বিভিন্নমুখী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
১। পরিবর্তিত পরিস্তিতির প্রতি সাড়া প্রদানঃ প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় সক্রিয় রয়েছে অসংখ্য উপাদান। রক্তের সম্পর্ক, ধর্মীয় বন্ধন, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক চেতনা প্রতিনিয়ত সমাজে পরিবর্তন আনয়ন করছে। এজন্যই সমাজ পরিবর্তনশীল, স্থবির নয়। শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে নয় রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক তথা রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর ক্ষেত্রে ঘটছে ব্যাপক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে সরকারই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসে। পরিবর্তিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং কৃষ্টিগত ক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিবেশ ও পরিস্তিতির সমঝোতা সাধন এবং যথোপযুক্ত সাড়া প্রদান করা রাষ্ট্রীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
২। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাঃ আধুনিক সরকারের অন্যতম আরেকটি সমস্যা হলো বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। সরকারের এই সমস্যাটি অত্যন্ত কঠিন প্রকৃতির। কারণ সমাজে ক্রিয়ারত প্রতিটি গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গোষ্ঠীগুলোর থাকে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, আদর্শ, কর্মসূচী ও বিশ্বাস। তারা প্রত্যেকেই স্বীয় কর্মসূচী ধরে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
অথবা দেখা যায় একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে চরম উত্তেজনা বা রাজনৈতিক সংকট। এক্ষেত্রে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করেন। তবে সরকার এরূপ অবস্থায় লক্ষ্য রাখেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ যেন অবহেলিত বা উপেক্ষিত না হয়।
৩। সঠিক শাসক নির্ধারণঃ অধ্যাপক উইলোবী ও রোজার্স বলেছেন, “To attempt to discover the real rulers is one of the most important tasks of political science”. তাঁদের এ ধরনের বক্তব্যের অন্যতম কারণ হলো প্রাচীন গ্রীসের নগররাষ্ট্রগুলোতে প্রকৃত শাসক নির্ধারণ করা খুব কঠিন কাজ ছিল না কিন্তু বর্তমানের আধুনিক সমস্যা জর্জরিত রাষ্ট্রগুলোতে প্রকৃত শাসক নির্ণয় করা বাস্তবিকই দুরূহ কাজ। অধিকাংশ উন্নয়নকামী রাষ্ট্রগুলোর নির্বাচকমন্ডলী মূলতঃ আবেগ, বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে তাদের দ্বারা প্রকৃত শাসক নির্ণয় সম্ভব নয়।
সুতরাং সরকার কি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা প্রকৃত অর্থে নির্ণীত হয় নৈতিক, মনস্তাত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক শক্তিসমূহ দ্বারা।
৪। সনাতন ধ্যান-ধারণা ও আধুনিকীকরণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনঃ উন্নয়নকামী রাষ্ট্রগুলোর সরকার যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয় তার মধ্যে সনাতন সমাজের সঙ্গে আধুনিকীকরণের যোগসূত্র স্থাপন উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। কিন্তু আধুনিক এই অগ্রযাত্রার সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিবর্তন আসে না সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সনাতন ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে। ফলে রাষ্ট্র অনেক সময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই বিপরীতমুখী দু’টি কাঠামোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে সরকার।
৫। রাজনৈতিক বিচ্যুতিঃ অনেক সময় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তরালে এমন সব উপাদান কাজ করে যা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কার্যক্রমকে ব্যবহৃত করে নতুন যাত্রা পথের সূচনা করে। যেহেতু রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলতঃ অবিন্যস্ত, ফলে এর অগ্রগতিতে অনেক সময় কোন ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬। আদর্শ এবং বাস্তবতার পার্থক্য দূরীকরণঃ আধুনিক সরকারের আরেকটি সমস্যা হলো আদর্শ এবং বাস্তবতার মধ্যে সৃষ্ট পার্থক্যকে কমিয়ে আনা। আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস, পূর্ব ধারণা, আনুগত্য ইত্যাদি উপাদানগুলো মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে বলে রাজনৈতিক উন্নয়ন আকঙ্খিত মাত্রায় এগিয়ে যেতে পারে না। ফলে আদর্শগত দিক থেকে যা উন্নত, গ্রহণযোগ্য বাস্তবে তা রূপায়িত করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু উন্নয়নগামী রাষ্ট্রগুলোর জনগণের রয়েছে রাজনৈতিক দীক্ষাদানের অভাব। ফলে রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি প্রায়শই বাধাপ্রাপ্ত হয় বা সীমিত হয়ে পড়ে। আধুনিক সরকারকে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে।
৭। সরকার ব্যবস্থায় মনস্তাস্তিক উপাদানঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে নতুন একটি পদ্ধতি যোগ হয়। ১৮৭৩ সালে ওয়ালটার বেজহটের সময় থেকে রাজনীতি আলোচনায় মনস্তাত্বিক পদ্ধতিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণের প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ দৃষ্টি নিবন্ধ করেন এবং রাজনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রের সরকারকে অবশ্যই মনস্তাত্বিক উপাদান সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। সরকার এক্ষেত্রে রাজনীতি ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে।
সরকারের সমস্যাবলী সম্পর্কিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরকারের সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের কার্যাবলীকে যেহেতু একটি নির্দিষ্ট গভীর মধ্যে আবদ্ধ সম্ভব নয়, তদ্রুপ সরকারের সমস্যাবলীর ধরন ও প্রকৃতিতেও গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশ সরকারের যে ধরনের সমস্যা রয়েছে আমেরিকার সরকারের সে ধরনের সমস্যা নাও থাকতে পারে। তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কিংবা সামরিক সরকারগুলোর সমস্যা ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে।
সুতরাং সরকারের সমস্যাবলী সম্পর্কিত আলোচনায় দেখা যায় সমস্যা যত বেশিই থাকুক না কেন উচ্চতর সরকার ব্যবস্থার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, দক্ষ প্রশাসন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানকারী সরকার একান্ত কাম্য।**