পদার্থ বিজ্ঞান

স্থির বিদ্যুতের ব্যবহার (Uses of Static Electricity)

1 min read

স্থির বিদ্যুতের ব্যবহার (Uses of Static Electricity)


স্থির বৈদ্যুতিক রং স্প্রে

গাড়ি, সাইকেল আলমারি বা অন্যান্য জিনিস রং করার জন্য ইদানিং রং এর স্প্রে ব্যবহার করা হয়। এটি করা হয় স্থির তড়িৎ ব্যবহার করে। স্প্রে গান এমনভাবে তৈরি করা হয় যে এটি রং এর অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আহিত কণা তৈরি করে। রং স্প্রে গানের সূচালো প্রান্তটি একটি স্থির তড়িৎ জেনারেটর এর এক প্রান্তের সাথে সংযুক্ত করা হয়। জেনারেটরের অপর প্রান্তটি যে ধাতব পাতটি রং করতে হবে তার সাথে সংযুক্ত থাকে। একটি গাড়ির রং করার ক্ষেত্রে স্প্রে গান থেকে নির্গত আহিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা গাড়ির বাইরের কাঠামো দ্বারা আকৃষ্ট হয়। ফলে গাড়ির বহিরাবরণের এর উপর রং এর একটি সুষম আস্তরণ পড়ে। এছাড়াও এই ক্ষুদ্র কণাগুলো তড়িৎ ক্ষেত্রের বল রেখা বরাবর চলে কাঠামোর অপ্রকাশ্য স্থানে পৌঁছে সেখানেও রং করে।

 

ইঙ্কজেট প্রিন্টার

এটি হচ্ছে সবচেয়ে সাধারণ ধরনের প্রিন্টার যা কম্পিউটারের সাথে সংযোগ দেওয়া থাকে। একটি ইঙ্ক-গান তার সূচালো মুখ দিয়ে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালির কণা নিক্ষেপ করে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো ধনাত্মক (+) ভাবে আহিত। এই কালির কণাগুলো দুটি পাতের মধ্যস্থল দিয়ে চলে। এই ধনাত্মক কালির কণাগুলোকে ধনাত্মক পাত বিকর্ষণ করে এবং এগুলো ঋণাত্মক পাতে আকৃষ্ট হয়।

একটি কম্পিউটার পাতগুলোর ভোল্টেজ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে পাতগুলো কখনো ধনাত্মক, কখনো ঋণাত্মক আধানে আহিত হয় এবং কালির কণাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে চলমান কাগজের উপর বিভিন্ন স্থানে পড়ে এবং প্রয়োজনমত অক্ষর বা ছবির আকৃতি ছাপে। রঙিন ছাপার জন্য চার রকমের রঙিন কালি ব্যবহার করা হয়।

 

ফটোকপিয়ার

আজকাল ফটোকপিয়ার বা ফটোকপি মেশিন খুবই প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয় একটি যন্ত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিবিধ অফিস ছাড়াও সাধারণ জনগণ যে কোনো প্রয়োজনীয় দলিল বা কাগজপত্রের এক বা একাধিক অবিকল কপির জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। এই যন্ত্রেও স্থির তড়িৎ ব্যবহার করা হয়। ফটোকপিয়ারের ভিতরে অন্ধকারে একটি ঘূর্ণায়মান ড্রাম থাকে। এই ড্রামের উপর ধনাত্মক আধান স্প্রে করা হয়। যে পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে হবে একটি উজ্জ্বল আলো তাকে আলোকিত করে। পৃষ্ঠার সাদা অংশ আলো প্রতিফলিত করে, কিন্তু অন্ধকার বা ছাপানো অংশ কোনো আলো প্রতিফলিত করে না। প্রতিফলিত আলো ড্রামের উপর কেন্দ্রিভূত হয়। ড্রামের যে স্থানটি সাদা কাগজ দ্বারা প্রতিফলিত আলো পড়ে উজ্জ্বল হয়, সেই অংশ থেকে আধান বের হয়ে যায়। ড্রামের কেবল অন্ধকার অংশই ধনাত্মক আধানে আহিত থাকে। ঋণাত্মকভাবে আহিত কার্বনের পাউডার কালি (টোনার) ড্রামের উপর স্প্রে করা হয়। ঋণাত্মকভাবে আহিত এই কালির কণাগুলো ড্রামের ধনাত্মকভাবে আহিত অংশের সাথে আঠালোভাবে লেগে থাকে। এক টুকরা সাদা কাগজকে ধনাত্মকভাবে আহিত করা হয়। এটিকে ড্রামের সাথে চেপে রাখা হয়। এই কাগজটি ড্রাম থেকে কার্বন পাউডারের প্যাটার্ন তার গায়ে তুলে আনে। টোনার (-)টি কাগজ (+) কর্তৃক আকৃষ্ট হবে। কাগজখানা উত্তপ্ত রোলারের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। এতে টোনারের কালি গলে যায় এবং কাগজের সাথে মিশে যায়, ফলে একটি স্থায়ী কপি তৈরি হয়।

 

স্থির তড়িতের বিপদ

অনেক ক্ষেত্রে স্থির তড়িতের উপস্থিতি অসুবিধাজনক এবং বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বিমানে জ্বালানি ভরা

আকাশে যখন বিমান উড়ে তখন বায়ুর সাথে ঘর্ষণের ফলে এটি তড়িতাহিত হতে পারে। বিমানের আধান বাড়তে থাকলে বিমান ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিভব পার্থক্য বাড়তে থাকে। এত উচ্চ বিভব পার্থক্যের কারণে বিমানে যখন জ্বালানি ভরা হয় তখন কিছু আধান ভূমিতে চলে যাওয়ার সময় স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা বিরাট বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। এই জন্য বিমানের চাকা পরিবাহী রাবার দ্বারা তৈরি করা থাকে, যাতে বিমান ভূমি স্পর্শ করলে বিমানে জমা হওয়া আধান নিরাপদে ভূমিতে চলে যেতে পারে। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে বিমান ভূমিতে অবতরণের পর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এবং জ্বালানি ভরা শুরু করার আগেই একটি পরিবাহী দ্বারা ভূ-সংযুক্ত করা।

 

ট্যাংকারে জ্বালানি ভরা

যে সকল ট্যাংকার লরি পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি জ্বালানি নিয়ে রাস্তা দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে তাদের বেলায়ও স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি ও বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জ্বালানি স্থানান্তরের আগে ভূসংযুক্ত করে নিতে হয়।

টেলিভিশন ও কম্পিউটারের মনিটর

ব্যবহারকালে টেলিভিশনের পর্দা ও কম্পিউটারের মনিটর স্থির তড়িতে আহিত হয়। এই আধানগুলো অনাহিত কণা যেমন ধুলোবালি ইত্যাদি আকর্ষণ করে, ফলে এগুলো তাড়াতাড়ি ময়লা হয়ে যায়।

 

কাপড় পাল্টানো

আমাদের পরিধেয় কাপড় চোপড় অনেক সময় নিজেদের মধ্যকার ঘর্ষণের ফলে আহিত হয়ে যেতে পারে। যখন আমরা কাপড় বদলাই তখন আধান ভূমিতে চলে যাওয়ার সময় আমাদের অল্প শক্ খাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।

অপারেশন থিয়েটার

যেহেতু ধুলোবালি ও জীবাণু আহিত বস্তু দ্বারা আকৃষ্ট হয়, কাজেই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে সাবধানতা অবলম্বন করা হয় যেন সার্জন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং চিকিৎসাসামগ্রী আধানমুক্ত থাকে। এ জন্য তাদেরকে ভূসংযুক্ত রাখার জন্য পরিবাহী রাবারের জুতা পরতে হয় এবং হাতে রাবারের গ্লাভস ব্যবহার করতে হয়, যাতে ভূমি থেকে সহজে ইলেকট্রন আসা যাওয়া করতে পারে।

 

পেট্রোলবাহী ট্রাকের সাথে ধাতব শিকল ঝুলানো থাকে

পেট্রোল, ডিজেল বা অন্য তরল জ্বালানিবাহী ট্যাংকার বা ট্রাকের সাথে একটি ধাতব শিকল লাগানো থাকে যা ট্রাক চলার সময় রাস্তা ছুঁয়ে যায়। যখন রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলে তখন পেট্রোল ট্যাংকের গায়ে বারবার ধাক্কা খায় এবং এদিক ওদিক দুলতে থাকে। ট্যাংকের সাথে পেট্রোলের এই ঘর্ষণের ফলে আধান সঞ্চিত হয়। যদি ট্যাংকের কিনারা থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয় তাহলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং পেট্রোলে আগুন ধরে যাবে। কাজেই পেট্রোল আধানের জন্য নিরাপদ স্থান নয়। ট্যাংকের পেছনে শিকল লাগিয়ে এই তড়িৎ ভূমিতে চলে যাবার পথ তৈরি করা হয়। যেহেতু ধাতু খুব ভালো পরিবাহী, তাই ধীরে ধীরে ধাতব শিকলের মধ্য দিয়ে মাটিতে চলে যায়।

বিদ্যুৎ লাইনের সাথে ধাতব খুঁটির সরাসরি সংযোগ থাকে না

রাস্তায় বিদ্যুৎ লাইনের তার খাটাবার সময় ধাতব খুঁটির সাথে সরাসরি সংযুক্ত করা হয় না। ধাতু তড়িতের সুপরিবাহী। ধাতব খুঁটির সাথে সরাসরি সংযোগ করা হলে তারের তড়িৎ খুঁটির মধ্য দিয়ে মাটিতে চলে যেত। কেউ ঐ খুঁটি স্পর্শ করলে সাথে সাথে তড়িৎস্পৃষ্ট হতো এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতো। তাই অপরিবাহী পোর্সেলিনের কাপের মধ্য দিয়ে তারকে খুঁটির সাথে সংযোগ দেওয়া হয়।

 

বজ্রপাত ও বজ্র নিরোধক

আমরা জানি, বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প থাকে। এই জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের আহিত আয়নগুলোর উপর ঘনীভূত হয়ে পানি কণার সৃষ্টি করে এবং তড়িতাহিত হয়। এই ধরনের পানি কণাগুলো একত্রিত হলেই মেঘের উৎপত্তি হয়। মেঘ ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যেকোনো ভাবেই আহিত হতে পারে। তড়িতাহিত দুটি মেঘ কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে তড়িৎক্ষরণ হয়, তখন বিরাট অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়। একে বিদ্যুচ্চমক বলা হয়।

 

বিদ্যুচ্চমকের সময় মেঘের চারপাশের বায়ুমন্ডল হঠাৎ তাপ পেয়ে প্রসারিত হয়। হঠাৎ প্রসারণের ফলে বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যায়। তখন আশে-পাশের বেশি চাপের বায়ু এসে এই প্রসারিত বায়ুকে সংকুচিত করে। খুব তাড়াতাড়ি এ ধরনের সংকোচন ও প্রসারণ হয় বলে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হয়। একেই মেঘ গর্জন বলে। তড়িতাহিত মেঘে যদি তড়িতের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে তা তড়িৎক্ষরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে চলে আসে। একে বলে বজ্রপাত।

বজ্রপাতের সাথে সাথে যে শব্দ শোনা যায় তাকে বলে বজ্রনাদ।

 

বজ্র নিরোধক

বজ্রপাতের ফলে যাতে বাড়ি-ঘরের ক্ষতি না হয় তার জন্য বজ্র নিরোধক ব্যবহার করা হয়। একটি ধাতব দণ্ডকে বাড়ির গা ঘেষে এমনভাবে স্থাপন করা হয় যেন এর উপরিভাগ ছাদের চেয়েও বেশি উঁচুতে থাকে এবং এর নিম্নভাগ ভালোভাবে মাটিতে পুতে রাখা হয়। দণ্ডের উপরিভাগে কয়েকটি সূচিমুখ থাকে।

যখন তড়িৎগ্রস্থ মেঘ বাড়ির উপরে আসে, তখন এটি দণ্ডে বিপরীত আধান আবিষ্ট হয়। কিন্তু দণ্ডের উপরি প্রান্ত তীক্ষ্মাগ্র বিশিষ্ট হওয়ায় ঐ তীক্ষ্মাগ্রগুলোতে বেশি আধান জমা হয় এবং সূচিমুখ দিয়ে তড়িৎক্ষরণ হয়। বায়ুকণাগুলো এই আধান নিয়ে আহিত হয় এবং মেঘের বিপরীত আধান কর্তৃক আকৃষ্ট হয়ে মেঘের দিকে চলে যায় এবং মেঘকে নিস্তড়িত করে। ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা কম থাকে।

 

তড়িৎ সবসময় পরিবাহীর মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ততম পথে চলে। মেঘে মেঘে সৃষ্ট তড়িৎ উঁচু বস্তুর ভিতর দিয়ে পৃথিবীতে আসতে চায়। ঝড় বৃষ্টির সময় তাই ছাতার নিচে, কোনো গাছের নিচে, তড়িৎ পরিবাহী ধাতুর কাছে, লোহার তৈরি পুল কিংবা কাঁটা তারের বেড়া দেওয়ালের কাছাকাছি দাঁড়ানোর চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা অনেক ভালো।

1/5 - (1 vote)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x