সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে? সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য | সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে কর্মনির্বাহী (ক্রিয়াবাদী) তত্ত্ব

সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে?

সমাজ জীবনের শুরু থেকে সমাজবিজ্ঞানীগণ সমাজে বসবাসকারী জনসমষ্টির মধ্যে বিভিন্ন স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। সমাজবদ্ধ ব্যক্তিবর্গকে উচ্চ-নীচ স্তর ভেদে বিন্যাস করার জন্য সমাজতাত্ত্বিকগণ ভূ-বিদ্যার স্তরের ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে সমাজতত্ত্বের আলোচনায় স্তরবিন্যাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

অধ্যাপক সরোকিন মনে করেন সকল সমাজের অধিবাসী বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। Peter Worsely সমাজতত্ত্বে শব্দটি প্রচলন করেন। অসম অবস্থানের দরুন সমাজস্থ মানুষকে মর্যাদার ভিত্তিতে উচ্চ-নীচ ভেদে বিভক্ত করা হলে তাকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।

অধ্যাপক বটমোর (Bottomore)-এর মতে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে মর্যাদা ও ক্ষমতা অনুযায়ী কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হলে তাকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।

Social Staratification is the division of the society into class or strata which forms a hierarchy of prestige and power.

অধ্যাপক টুমিন বলেন সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে সম্পত্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদির ভিত্তিতে অসমভাবে বিভক্ত করা হলে তাকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।

(By social stratification we mean the arrangement of any social group or society into a hierarchy of position that are unequal with regard to power, property and social evaluation.)

 

তাঁর মতে, সামাজিক স্তরবিন্যাস হল মানব সমাজের এক সুপ্রাচীন ব্যবস্থা।

সুতরাং সামাজিক স্তরবিন্যাসের ফলে সমাজে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মর্যাদার ভিত্তিতে পৃথকীকরণ সূচিত হয়।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য

সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

১)  সম্পত্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতা অথবা মর্যাদা পার্থক্যের দরুন স্তরবিন্যাস ঘটে থাকে। স্তরবিন্যাসের সঙ্গে মর্যাদার প্রশ্নটি জড়িত।

২) স্তরবিন্যাসের দরুন ব্যক্তিবর্গের জীবন ধারণের প্রণালীতে পার্থক্য সূচিত হয়।

৩) স্তরবিন্যাসের ফলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া অনেকক্ষেত্রে নির্দিষ্ট স্তরের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়।

 

৪) স্তরবিন্যাস ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে।

৫) এই স্তরবিন্যাসের ফলে মর্যাদা অর্জিত অথবা আরোপিত হয়ে থাকে।

৬) স্তরবিন্যাস হল সর্বজনীন। কোনো না কোনো অর্থে সমস্ত সমাজে পরিলক্ষিত হয়।

ম্যাকাইভার ও পেজ স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন-

১) মর্যাদাভিত্তিক ক্রমিক স্তর বিভাগ;

২) উচ্চতর ও নিম্নতর ব্যবধানে স্বীকৃতি এবং সচেতনতা;

৩) এই বিভাজন সাধারণভাবে স্থায়ী।

 

সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে কর্মনির্বাহী (ক্রিয়াবাদী) তত্ত্ব

অধ্যাপক সরোকিন-এর মতে উচ্চ-নীচ ভেদে সমাজের জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করার প্রক্রিয়া হল সামাজিক স্তরবিন্যাস। “Social Stratification is the division of society into classes of Strata on the basis of prestige and power.”

মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী সামাজিক বৈষম্য ও স্তরবিন্যাস চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী প্রতিটি সমাজে স্তরবিন্যাস ও বৈষম্য হল অপরিহার্য ও চিরস্থায়ী। সমাজকে সুসংহত রাখার ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরবিন্যাস ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানী ডেভিস ও ম্যুর সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে ক্রিয়াবাদী তত্ত্বকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেন।

ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী সকল সমাজেই স্তরবিন্যাস বর্তমান। প্রতিটি সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। পদ ও মর্যাদার দিক থেকে একটি সামাজিক ভূমিকা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরটি কম তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া সকল ব্যক্তির যোগ্যতা এবং গুণ সমান নয়।

সুতরাং ভূমিকার পার্থক্যের দরুন এবং যোগ্যতার পার্থক্যের দরুন বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফল লাভ করে। সামাজিক স্তরবিন্যাস এইভাবে সৃষ্টি হয় এবং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য মর্যাদা দান করে। সুতরাং স্তরবিন্যাস বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তির সম্পর্ক রক্ষা করে এবং সমাজের শৃঙ্খলা সংরক্ষণ করে।

 

সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে ক্রিয়াবাদী তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করলে কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। 

১) মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কয়েকটি ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্ত ভূমিকা পালনের জন্য বিশেষ যোগ্যতা প্রয়োজন।

২) সমাজের সকল ব্যক্তি সমান দক্ষতার অধিকারী নয়। অধিক দক্ষ ও গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিক সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন।

৩) অধিক মর্যাদা ও অধিক সুবিধার ব্যবস্থা থাকলে একটি সমাজ যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে পারে।

৪) সমাজের স্তরবিন্যাস, অর্থাৎ মর্যাদার পার্থক্যের ফলে সমাজের সংহতি রক্ষিত হয়।

 

সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে ক্রিয়াবাদী তত্ত্বকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সমালোচনা করা হয়।

প্রথমত, সকল সমাজে এইরূপ অনেক ব্যক্তি রয়েছে যারা উন্নত গুণের অধিকারী নয়, কিন্তু অধিক অর্থনৈতিক সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করে। ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব অত্যন্ত সরলভাবে শ্রেণীবিন্যাসকে ব্যাখ্যা করেছে।

দ্বিতীয়ত, ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজের সকল ব্যক্তি সমান প্রতিভাবান নয়। কিন্তু সামাজিক বৈষম্যই প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে অধিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও মর্যাদার দরুন অযোগ্য ব্যক্তিরা গুণের বিকাশ ঘটায়।

তৃতীয়ত, সামাজিক বৈষম্য ও স্তরবিন্যাসের ফলে সমাজের সংহতির পরিবর্তে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের পথ প্রশস্ত হয়। Inequality leads to social conflict.

 

এই সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে ও কর্মনির্বাহ তত্ত্বটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সমাজতাত্ত্বিক উইলিয়াম ডেভিসের মতে, “Social Stratification is universal” অর্থাৎ সামাজিক স্তরবিন্যাস হল সর্বজনীন। বিশ্বের সকল সমাজব্যবস্থায় কমবেশি স্তরবিন্যাস লক্ষ করা যায়। সমাজ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাচীন যুগেও দলপতির প্রভুত্বকে কেন্দ্র করে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি অথবা পরিবার বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। সমাজতত্ত্ববিদগণ তাকে স্তরবিন্যাসের সূচনা পর্ব রূপে অভিহিত করেন। সমাজে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে এবং স্তরভেদও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সমাজতত্ত্ববিদগণ উল্লেখ করেন যে একটি সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই সমস্ত কাজগুলির গুরুত্ব ও মর্যাদা এক নয়। প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতার প্রয়োজন।

শ্রমের দিক থেকেও কোনো কাজ সহজসাধ্য এবং কোনো কাজ শ্রমসাধ্য। কাজের গুরুত্ব ও জটিলতার ক্ষেত্রে পার্থক্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধা দান করা হয়। সুযোগ-সুবিধা এবং মজুরির ক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে কেন্দ্র করে সামাজিক স্তরবিন্যাস লক্ষ করা যায়। স্তরবিহীন সামাজিক ব্যবস্থা পৃথিবীতে বিরল।

Similar Posts