দর্শন

ইচ্ছার স্বাধীনতা কি এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ

1 min read

ইচ্ছার স্বাধীনতা কি

ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিক বিচারের একটি স্বীকার্য সত্য বা মূল সত্য। নৈতিক বিচারে আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তিকে স্বীকার করে নেয়া হয়। ব্যক্তির ইচ্ছার ও কর্মের স্বাধীনতা আছে। ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা না থাকলে নৈতিক দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধের কোনো প্রশ্নই উঠে না। বিরোধের কামনার ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি উপলব্ধি করতে পারি। যে কোনো দিক কাজ করার ক্ষমতা আমাদের আছে। একটি কাজ পরিত্যাগ করে, অন্য একটি কাজকে নির্বাচন করার ক্ষমতা আমাদের আছে। ঐচ্ছিক নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু। ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূলভিত্তি হলো কর্মকর্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। কর্মকর্তা যদি তার স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে তার কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করতে না পারে, তবে কর্মের ফলাফলের জন্য তাকে দায়ী করা যায় না। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে যে কর্ম সম্পাদন করে, সে কর্মের জন্য কর্মকর্তাকে দায়ী করা যায় এবং সে কর্মকেই ভালো কী মন্দ তা বলা যায়। তাই ইচ্ছার স্বাধীনতাকে নৈতিক বিচারের স্বীকার্য সত্য বলে গণ্য করা হয়।

ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা

মানুষ স্বাধীন কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, পরস্পর বিরোধী বিষয়গুলো থেকে কোনো একটি বেছে নিতে আমরা স্বাধীন। আবার কেউ বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। কারো মতে, ইচ্ছা স্বাধীনও নয় পরাধীনও নয়, আমাদের ইচ্ছা আমাদের অধীন। ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ চারটি। অন্যভাবে বলতে গেলে, ইচ্ছার স্বাধীনতা বিষয়ক মতবাদ চার প্রকার। যথা,

  • অদৃষ্টবাদ
  • নিয়ন্ত্ৰণবাদ
  • অনিয়ন্ত্রণবাদ
  • আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ

১. অদৃষ্টবাদ

প্রত্যেক ঘটনারই যে একটা কারণ রয়েছে, একথা অদৃষ্টবাদ অস্বীকার করে না। তবে কোনো ঘটনাকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে- এ কথাকে এ মতবাদ অস্বীকার করে। এ মতবাদের প্রধান শ্লোগানই হলো “যা ঘটতে যাচ্ছে, তা ঘটতে থাকবে”। “যা হওয়ার, তা হবে”। অদৃষ্টবাদের এ শ্লোগানগুলো বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য হিসেবে উত্থাপিত হয় না, বরং এ বক্তব্যগুলো এটাই বুঝায় যে, আমরা যা কিছুই করি না কেন, ভবিষ্যৎ তার আপন ধারায় নির্দিষ্ট প্রকৃতিরই হবে। অদৃষ্টবাদ অনুসারে মানুষের ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা নেই। এ মতবাদের মূলকথা এই যে, শুধু মানসিক ঘটনা কেন, প্রকৃতির এমন কোনো ঘটনা নেই, যা পূর্বনির্ধারিত নীতি বা শাশ্বত শক্তির নিয়ম মেনে না চলে। ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ, দুঃখ, চিন্তা আদর্শ সবকিছুই প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মকানুন বা অদৃষ্টের ফলমাত্র। মানুষ শতচেষ্টা করেও তার ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে না।

সমালোচনা : অদৃষ্টবাদ এমন একটা ত্রুটিপূর্ণ মতবাদ, যা গ্রহণযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদের দোহাই দিয়ে যাঁরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে চান, তাঁদেরকে এ মতবাদ তুষ্ট করলেও এ মতবাদ একটা অসন্তোষজনক মতবাদ। ঘটনাচক্রই মানুষের কর্মধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং মানুষের ইচ্ছা ও কর্মধারাও ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই অদৃষ্টে যা আছে তা এড়ানোর কোনো উপায় নেই, একথা ঠিক নয়। অদৃষ্টবাদের পক্ষে যে যুক্তি দাঁড় করানো হয় তা বেশ ত্রুটিপূর্ণ।

২. নিয়ন্ত্রণবাদ

নিয়ন্ত্রণবাদের মতে, যা কিছু ঘটে তা নিয়ন্ত্রিত। ‘নিয়ন্ত্রিত’ শব্দটির অর্থটি পরিষ্কার না থাকার দরুন অনেক সময় আমরা অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হই। “তুমি যা কিছু করছ, তার সবই নিয়ন্ত্রিত”- এ বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ বক্তব্যটিতে ‘নিয়ন্ত্রিত’ শব্দটির মধ্যে একটা ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের ক্রিয়াকলাপ বা কর্মধারার মধ্যে আমাদের নিজেদের কোনো কিছুই করণীয় নেই। আমরা চাই বা না চাই, ক্রিয়াগুলো অনুষ্ঠিত হবেই।

সমালোচনা : নিয়ন্ত্রণবাদে ইচ্ছার যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা সন্তোষজনক নয়। একথা সত্য যে, আমাদের ইচ্ছা বা কামনা আমাদের সরলতম কামনার জগৎ বা পরিবৃত্তও চরিত্রের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও মানুষ কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে কী ইচ্ছা বা সংকল্প গ্রহণ করবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তাছাড়া ইচ্ছা বা সংকল্পের অর্থই হলো কামনা বা অভিলাসের মুক্ত নির্বাচন এবং এ মুক্ত নির্বাচনের অর্থই ইচ্ছা বা সংকল্পের স্বাধীনতা। তাছাড়া মানুষের কার্যক্রম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় বলে যে ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই, একথা মনে করা যুক্তিসংগত নয়। আমাদের জানা দরকার, প্রাকৃতিক নিয়মের মতো সংকল্প বা ইচ্ছা কোনো পূর্ব ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা নিয়ন্ত্রণবাদের কার্যকারণ নিয়মের যুক্তিটি সন্তোষজনক নয়। প্রকৃতির নিয়মগুলো শাসন করে না এবং কোনো বস্তুকে নিয়ন্ত্রণও করে না।

৩. অনিয়ন্ত্রণবাদ

অনিয়ন্ত্রণবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের বিপরীত মতবাদ। ‘জগতে যা কিছু ঘটে তার একটা কারণ রয়েছে এ বক্তব্যকে অনিয়ন্ত্রণবাদ অস্বীকার করে। কেননা এ বক্তব্য স্বীকার করলে মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা থাকে না। অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মানুষের ইচ্ছা বা মনন ক্ষমতা মুক্ত ও স্বাধীন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় মানুষের সামনে একাধিক পন্থা খোলা থাকে এবং তার স্বাধীন মনন ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে কোনো একটি পন্থা সে বেছে নিতে পারে।

সমালোচনা : নৈতিক দায়িত্বের বা নৈতিক জীবনের তাৎপর্য রক্ষা করার জন্য ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে একথা ঠিকই, কিন্তু সে স্বাধীনতা আমাদের সত্যিকারের আছে কি না এবং থাকলে তা কতটুকু আছে, তা বিচার্য বিষয়। অনিয়ন্ত্রণদের মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি বা বিশ্লেষণ সবার জন্য সমভাবে গ্রহণযোগ্য তা বলা যায় না। তাছাড়া অনিয়ন্ত্রণবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের মতো ইচ্ছা বা সংকল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক কোনো যুক্তি দেখাতে পারেনি।

৪. আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ

মানুষ আত্মজ্ঞান সম্পন্ন জীব এবং তার আত্মসচেতনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। বাইরের শক্তি বা পরিবেশ মানুষের চরিত্র বা কর্মকে প্রভাবিত করলেও ব্যক্তি নিজেই নিজের কর্মকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করতে পারে। এ নির্বাচন বা স্বাধীনতা হলো ব্যক্তির চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আত্মঘটিত, আত্মোদ্দেশ্য প্রণোদিত ও আত্মনিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। স্বাধীনতা হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মপ্রকাশ ও আত্মোন্নয়ন। সার্বিক কার্যকারণে কারণিক কর্তা হিসেবে আত্মস্বাধীনভাবে তার কর্মকে নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ‘নরম’ নিয়ন্ত্ৰণবাদ (‘Soft’ determinism) নামে অভিহিত আত্মনিয়ন্ত্রণবাদ বা স্বনিয়ন্ত্ৰণবাদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ

উক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কীয় মতবাদগুলোর মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণবাদকেই একটি সুষ্ঠু মতবাদ বলে মনে হয়। অদৃষ্টবাদ, নিয়ন্ত্রণবাদ, অনিয়ন্ত্রণবাদের ত্রুটিকে দূরীভূত করে ইচ্ছার স্বাধীনতার কথা একমাত্র আত্মনিয়ন্ত্রণবাদই ঘোষণা করে। এদিক থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণবাদের সাথে ইচ্ছার স্বাধীনতা সংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x