ব্যবস্থাপনার একটি গতিশীল ও সম্প্রসারিত প্রক্রিয়া হল বিকেন্দ্রীকরণ। বর্তমানে কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ ব্যতীত বৃহদায়তন ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ দক্ষতার সাথে পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই বৃহদায়তন উৎপাদন ও বণ্টনের সফল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাছাড়া বৃহদায়তন কারবারের ক্ষেত্রে এটি অধিক সুবিধা প্রদান করে।
বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা বা গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা
বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা বা গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বা সুফলসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল।
১. গতিশীলতা বৃদ্ধি (Increasing mobility) : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে পরিবর্তনশীল অবস্থা স্থানীয় অবস্থা অনুসারে অতি স্বল্প সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এতে সংগঠনের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
২. মনোবল বৃদ্ধি (Increasing morale) : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে অধস্তন কর্মীরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ফলে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং মনোবলও বৃদ্ধি পায়।
৩. নেতৃত্বের বিকাশ (Expansion leadership): বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্তরের নির্বাহিদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। তবে প্রতিষ্ঠান কখনও নেতৃত্বের বাধার সম্মুখীন হয় না।
৪. কার্যভার হ্রাস (Reducing work load) : বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে অধস্তন নির্বাহিদের উপর অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও নির্দেশনা দানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ফলে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকগণের কর্মভার লাঘব হয়।
৫. সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ (Proper controlling) : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রতিষ্ঠানের বা সংগঠনের বিভিন্ন বিভাগ ও নির্বাহিদের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়। ফলে কে কোন কাজের জন্য দায়ী থাকে, কিভাবে নির্দেশ প্রদান করতে হবে প্রভৃতি বিষয়ে যথাযথভাবে নির্ধারণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
৬. কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি (Increase efficiency) : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে স্থানীয় নির্বাহির উপর অনেক নতুন কাজের দায়িত্ব অর্পিত হয়। ফলে তারা নতুন দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৭. সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন (Proper co-ordination) : কেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত অধস্তন কর্মীদের সাথে সহজে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফলে বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন সহজতর হয়।
৮. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Quick decision making): বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করতে হয় না। এক্ষেত্রে নির্বাহি তার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্থানীয় সমস্যা সমাধান করতে পারেন। ফলে বিকেন্দ্রীকরণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে।
৯. সম্প্রসারণের সুবিধা (Extension facilities): বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা সংগঠনকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণে সাহায্য করে। কারণ এরূপ ব্যবস্থা ব্যতীত কোন সংগঠনের শাখা প্রশাখা দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারিত করা যায় না।
১০. পারস্পরিক সহযোগিতা (Mutual co-operation) : এরূপ ব্যবস্থা অধস্তনদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। কারণ এর ফলে অধস্তন কর্মীগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে পারে।
১১. প্রশিক্ষণের সুবিধা (Training facilities) : এরূপ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে অধস্তন নির্বাহি কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার লাভ করতে পারে। ফলে নির্বাহিরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দক্ষতার সাথে সংগঠন পরিচালনার ব্যাপারে সুযোগ লাভ করে।
১২. প্রশ্ন বিভাগের সুবিধা (Division of labour facilities) : বিকেন্দ্রীকরণ শ্রম বিভাগ ব্যবস্থা প্রয়োগের অনুকূলে কাজ করে। এর ফলে শ্রম বিভাগের সু নীতি ভোগ করা যায়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখা ও বিভাগের মধ্যে দায়িত্বের পাশাপাশি ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বণ্টন করা যায়।
১৩. ঝুঁকি হ্রাস (Reducing risk) : এরূপ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগঠনের ঝুঁকি বিভিন্ন শাখায় বিস্তৃত করে দেওয়া হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পায়।
১৪. পদোন্নতির ভিত্তি (Basis of promotion): বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ব্যবস্থাপনার নিম্ন ও মধ্যম স্তরে পদ সৃষ্টির প্রয়োজন হয়। এতে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের পদোন্নতির ভিত্তি রচিত হয়।
১৫. মিতব্যয়িতা অর্জন (Achieving ceonomy) : বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নিম্ন স্তরের কর্মচারী ও মধ্যম স্তরের কার্য নির্বাহিদের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভবপর হয়। ফলে প্রত্যেক কাজ সফলতার সাথে সম্পাদন করা যায়।
বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধা
বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থাপনার একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য হলেও এর কতকগুলো ক্ষতিকর দিক বিদ্যমান। এর ফলে সামগ্রিকভাবে যেমন প্রতিষ্ঠানের কার্য ব্যয় বৃদ্ধি পায় তেমনি সমন্বয় সাধন, জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বা অসুবিধায় পড়তে হয়। ফলে প্রতিষ্ঠান অসুবিধা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। সমফলতা অর্জন করতে পারে না। তাই সুষ্ঠু বিকেন্দ্রীকরণের প্রচুর সফলতা থাকলেও এ ব্যবস্থায় অনেকগুলো আলোচনা করা হল।
বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা। নিম্নে বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধা বা সমস্যা বা কুফলসমূহ আলোচনা করা হল।
১. জরুরি অবস্থা মোকাবিলার অসুবিধা (Problem in facing emergency) : এরূপ ব্যবস্থায় বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগে নিয়োজিত অধস্তনদের উপর কর্তৃত্ব অর্পণ করা হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের সাথে সম্পর্কিত কোন জরুরি অবস্থায় শলাপরামর্শ করলে অনেক সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। ফলে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় অসুবিধা দেখা যায়।
২. ব্যয়বহুল (Costly) : বিকেন্দ্রীকরণ একটি ব্যয়বহুল কাজ। কেননা এরূপ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে অধিক লোক নিয়োগ করতে হয়। ফলে এদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি সুবিধাদি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করতে হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের খরচ বৃদ্ধি পায়।
৩. সমন্বয়ে অভাব (Lack of co-ordination): বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের নিম্ন স্তরের কর্মীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখে। এতে ব্যবস্থাপনার এক স্তরের সাথে অন্য স্তরের যোগাযোগ স্থায়ী হয় না। ফলে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে প্রায়শই সমন্বয়ের অসুবিধা সৃষ্টি হয়।
৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিলতা (Complexity of decision making) : বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দরকার হলে নিম্ন পদস্থ মধ্যম স্তরের নির্বাহিদের সাথে আলাপ-আলোচনা ব্যতীত এককভাবে শীর্ষ বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
৫. নিয়ন্ত্রণের অভাব (Lack of control) : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রতিটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে সরকার বা আইন ও ব্যবসায়গত নীতি নির্ধারণের দরকার হলে অসুবিধা দেখা দেয়।
৬. অধস্তনদের অযোগ্যতা : এরূপ ব্যবস্থায় নিম্ন পর্যায়ের কর্মী বা নির্বাহিরা অযোগ্য ও দক্ষ বলে বিকেন্দ্রীকরণ সুবিধার তুলনায় অসুবিধা আনয়ন করে অধিক।
৭. আদেশের ঐক্য বিঘ্নিত : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আদেশের ঐক্য বিঘ্নিত হয়। ফলে কাজের শৃঙ্খলা ও সমন্বয় বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮. আন্তঃবিভাগীয় দ্বন্ধ (Interdivisional conflict) : বিকেন্দ্রীকরণে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অবনতি ঘটে। এতে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীবৃন্দের মধ্যে আন্তঃবিভাগীয় কোন্দল ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
৯. নীতি গ্রহণ অসুবিধা : বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ ও স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও কর্তৃত্ব অপর্ণের ক্ষমতা থাকার কারণে নীতিমালা সহজে গ্রহণ করা যায় না।
১০. ক্ষমতার অপব্যবহার : এরূপ ব্যবস্থায় অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কেননা অধস্তন কর্মীরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক সময় ধরাকে সরাজ্ঞান করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রলুদ্ধ হয়।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা দুই আছে। তবে এর অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রায় সকল দেশেই ক্রমে জনপ্রিয় ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে এর পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে অনেক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।