অর্থনীতি

অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাসমূহ কি কি আলোচনা কর | কীভাবে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে

1 min read

মানুষ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। জন্মলগ্ন থেকেই সে সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়ে। সম্পদের তুলনায় অভাব বেশি হওয়ার কারণে মানুষকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ সমস্যাগুলোর কিভাবে সমাধান করা যাবে তার উপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক সমস্যাবলি।

অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাসমূহ

অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতির যেসব সংজ্ঞা প্রদান করেছেন সেগুলো বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো মৌলিক সমস্যার সন্ধান পাওয়া যায়। অধ্যাপক স্যামুয়েল সন পরস্পর নির্ভরশীল তিনটি মৌলিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, মৌলিক সমস্যাগুলো নিম্নরূপ :

১. কি দ্রব্য উৎপাদন করা হবে

অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সীমিত। এ সীমিত সম্পদ কিভাবে বণ্টন করতে হবে তাই অর্থনীতির প্রথম মৌলিক সমস্যা। এজন্য অসীম অভাবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভাবটি প্রথমে পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সম্পদ সীমিত হলেও সম্পদের বিকল্প ব্যবহার বিদ্যমান। সম্পদের এ বিকল্প ব্যবহারের মধ্যে বণ্টনের যে সমস্যা তা থেকে কোন দ্রব্য কতটুকু উৎপাদন করা সম্ভব এবং একটি দ্রব্য নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদন করতে অন্য দ্রব্যের উৎপাদন কতটুকু ছেড়ে দিতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে অন্য একটি সমস্যা থেকে যায় বা ক্রমশ বেড়ে যায়। সম্পদ বণ্টনের এ সমস্যা চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল:

কি দ্রব্য উৎপাদন করা হবে

চিত্রে, PQ হল একটি উৎপাদন সম্ভাবনা রেখা যা সম্পদের পরিমাণ প্রদত্ত অবস্থায় অর্থনীতিতে X এবং Y দ্রব্যের যেসব সংমিশ্রণে উৎপাদন হতে পারে তা প্রকাশ করে। যদি সব সম্পদ Y দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োগ করা হয় তাহলে P বিন্দুতে Y এর উৎপাদন সর্বোচ্চ হবে। আবার যদি সব সম্পদ X দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োগ করা হয় তাহলে Q বিন্দুতে X এর সর্বোচ্চ উৎপাদন হবে। এক্ষেত্রে P বিন্দুতে X এর উৎপাদন শূন্য এবং Q বিন্দুতে Y এর উৎপাদন শূন্য। চিত্রে a বিন্দুতে X এর উৎপাদন X1 পরিমাণ এবং Y এর উৎপাদন Y2 পরিমাণ । তাই a বিন্দু (X1, Y2) সংমিশ্রণ প্রকাশ করে। আবার b বিন্দু (X2, Y1) সংমিশ্রণ প্রকাশ করে। সুতরাং, PQ রেখা সম্পদ প্রদত্ত অবস্থায় X এবং Y এর উৎপাদন সীমা প্রকাশ করে। সমাজ PQ রেখার যে কোন বিন্দুতে অবস্থান করলে সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার হবে। কিন্তু সমাজ যদি F বিন্দুতে উৎপাদন করতে চায় তাহলে সম্পদ অব্যবহৃত থাকবে। আবার সমাজ ইচ্ছা করলেই c বিন্দুতে X ও Y দ্রব্যের উৎপাদন করতে পারে না। কারণ, সম্পদ সীমাবদ্ধ বলে PQ রেখার বাইরে X ও Y দ্রব্যের উৎপাদন সম্ভব নয়।

২. কিভাবে উৎপাদন করা হবে

দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে সীমাবদ্ধ সম্পদ দ্বারা কিভাবে দ্রব্য উৎপাদন করা হবে। কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনের জন্য বিকল্প কৌশল লক্ষ্য করা যায়। কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ যে অনুপাতে ব্যবহার করতে হয় তাকে উৎপাদন কৌশল বলে। উৎপাদন করার সময় বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে বিকল্প ব্যবহার করা সম্ভব। এ সম্ভাবনা থাকার কারণে একই পরিমাণ উৎপাদনের জন্য বিকল্প উৎপাদন কৌশল ব্যবহার করা সম্ভব। উপকরণ ব্যবহারের তীব্রতা অনুযায়ী উৎপাদন কৌশল শ্রম নিবিড় বা মূলধন নিবিড় হতে পারে। নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনে যদি শ্রম অপেক্ষা মূলধন বেশি নিয়োগ করা হয় তাহলে তাকে মূলধন নিবিড় এবং মূলধন অপেক্ষা শ্রম বেশি নিয়োগ করা হলে তাকে শ্রম নিবিড় কৌশল বলে। চিত্রের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হল :

কিভাবে উৎপাদন করা হবে

চিত্রে ভূমি অক্ষে শ্রম (L) এবং লম্ব অক্ষে মূলধন (K) নির্দেশিত। চিত্রে Q এবং Q রেখা দুটি সম উৎপাদন রেখা। Q রেখা Q0 রেখা অপেক্ষা বেশি উৎপাদন নির্দেশ করে। চিত্রে OR রেখা মূলধন নিবিড় এবং OS রেখা শ্রম নিবিড় উৎপাদন কৌশল প্রকাশ করে। এ দুটি উৎপাদন কৌশলের মধ্যে যে কোন একটি ব্যবহার করে Q0 বা Q1 সম উৎপাদন রেখায় উৎপাদন সম্ভব। সম্পদের পরিমাণ প্রদত্ত থাকলে তার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য অনেক সময় উৎপাদন কৌশলের সংমিশ্রণ করার প্রয়োজন হতে পারে। চিত্রে F বিন্দুতে L এবং K এর পরিমাণ প্রদত্ত। এখন OR বা OS কৌশলের যে কোন একটি ব্যবহার করলে কোন একটি সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হবে না।

এক্ষেত্রে প্রথমে OR কৌশল OF পরিধিতে ব্যবহার করা যায়। পরে OS কৌশল EF পরিধিতে ব্যবহার সম্ভব। বিকল্পভাবে OS কৌশল প্রথমে OG পরিধিতে এবং পরে OR কৌশল FG পরিধিতে ব্যবহার করা যায়। এ দুটি উপায়ের মধ্যে যে কোনটি ব্যবহার করে F বিন্দুতে পৌঁছা সম্ভব। অর্থাৎ, এভাবে সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করে Q1 স্তরে পৌঁছা সম্ভব।

৩. কার জন্য উৎপাদন করা হবে

উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বণ্টনের উপর সমাজের কল্যাণ নির্ভর করে। মানুষের অভাব অসীম। কিন্তু ভোগের মাধ্যমে সর্বাধিক কল্যাণ প্রাপ্তি মুখ্য উদ্দেশ্য। উৎপাদন কোন প্রক্রিয়ায় বণ্টিত হলে সমাজ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, এরূপ একটি বণ্টন ব্যবস্থার উদ্ভাবনই অর্থনীতির অন্যতম প্রধান মৌলিক সমস্যা। দ্রব্যসামগ্রীর বণ্টন যদি-মুষ্টিমেয় মানুষের কল্যাণে হয় তবে সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ হবে না। তাই এরূপ বণ্টন কখনো কাম্য হতে পারে না। সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা যা সমাজের কল্যাণ সর্বাধিক করবে তাই নির্ধারণ করা মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধান

দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোভেদে অর্থনীতির এ মৌলিক সমস্যাবলির সমাধানের উপায় বিভিন্ন হয়। সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া বিভিন্ন হলেও ফলাফল প্রায় একই রকম। নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিভাবে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করা হয় তা আলোচনা করা হল।

১. ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়

ধনতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিদ্যমান। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সম্পদের উৎপাদন, ভোগ, বণ্টনের উপর অবাধ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই উৎপাদনকারী কি উৎপাদিত হবে, কতটুকু উৎপাদিত হবে, কার জন্য উৎপাদিত হবে, কোন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হবে, উৎপাদিত পণ্য কিরূপে ভোগ ও বণ্টিত হবে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা্য উৎপাদনের মূলভিত্তি হল মুনাফা। উদ্যোক্তা এমনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যেন তার মুনাফা সর্বোচ্চ হয় অথবা ক্ষতি সর্বনিম্ন হয়। উৎপাদন ক্ষেত্রে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে উদ্যোক্তা তার স্বীয় দক্ষতা বলে তা সমাধান করে। ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় চাহিদা ও যোগানের খাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে ভারসাম্য বাজার দাম নির্ধারিত হয়। এ স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনীতিতে উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন নিয়ন্ত্রিত হয়। কোন প্রকার সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের সাহায্যে কি উৎপাদন করা হবে, কার জন্য উৎপাদন করা হবে, কিভাবে উৎপাদন করা হবে এসব সমস্যার সমাধান হয়।

২. সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়

এ সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তি তথা ভোক্তার কোন স্বাধীনতা থাকে না। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে নিয়ন্ত্রণ। ভোক্তার সার্বভৌমত্ব নেই, কিন্তু সর্বনিম্ন সুখ ভোগ ও ভোগের সুযোগ রয়েছে। উৎপাদনের উপকরণসমূহের মালিকানা সমগ্র সমাজের উপর ন্যস্ত। সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়। বাজারে চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে দাম নির্ধারিত হয় না। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিশন নির্ধারণ করে কোন দ্রব্য উৎপাদিত হবে, কি উপায়ে উৎপাদিত হবে, কতটুকু উৎপাদিত হবে এবং কার জন্য উৎপাদিত হবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কমিশন নির্ধারণ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের জন্য কতটুকু দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিত হবে এবং কিভাবে বণ্টিত হবে। মার্কসীয় ধারণা অনুযায়ী, প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় যে দাম থাকে তা চাহিদা ও যোগানের প্রতিফলন নয়। সরকার যে কোন সময়ে পামকে প্রভাবিত করতে পারে। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দামে ভোক্তা নির্দিষ্ট দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য থাকে।

৩. মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়

মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের দাম ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুটিই পাশাপাশি অবস্থান করে। এ ব্যবস্থায় ভোক্তা ও উদ্যোক্তার সার্বভৌমত্ব সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। সরকার কর্তৃক কতকগুলো অর্থনৈতিক কার্যাবলির ভার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অবশিষ্ট খাতসমূহ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত হয়। এখানে সরকার কখনো আইনের মাধ্যমে, আবার কখনো সরাসরি রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার আর্থিক নীতি, বাণিজ্য নীতি ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে উৎপাদনকারীগণকে পরিচালনা করেন। কি উৎপাদিত হবে, কোন উপায়ে উৎপাদিত হবে, কার জন্য উৎপাদিত হবে এসব বিষয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সরকারি বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে যে দাম নির্ধারিত হয়, তার ভিত্তিতে উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত দ্রব্যের দাম নির্দিষ্ট হয়। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান।

৪. ইসলামি অর্থব্যবস্থায়

আল-কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যে অর্থনীতি পরিচালিত হয় তাকে ইসলামি অর্থনীতি বলে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় কল্যাণের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরূপ অর্থব্যবস্থায় যেসব দ্রব্য জনগণের কল্যাণ সাধনে সক্ষম, ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত সেসব দ্রব্য উৎপাদনে উৎপাদনকারীগণ মূলধন বিনিয়োগ করবে এবং উৎপাদনে একে অপরকে সহযোগিতা করবে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় কোন প্রকার ক্ষতিকর বা হারাম দ্রব্যের উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ মানবকল্যাণের পরিপন্থি কোন দ্রব্য উৎপাদন করলে জনসাধারণ ও সরকার বাধা দিবে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় যদি দেশটি জনবহুল হয় তাহলে শ্রম নিবিড় শিল্প অগ্রাধিকার পাবে এবং দেশটি পুঁজি বহুল হলে পুঁজি নিবিড় শিল্পকে উৎসাহিত করা হবে। ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব নাগরিকের জন্য অথবা রপ্তানির জন্য উৎপাদন পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকগণের ভোগকে সংকুচিত করে বিলাসজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা ইসলামি অর্থব্যবস্থার পরিপন্থি।

উপসংহার

উপরিউক্ত অর্থব্যবস্থার মধ্যে প্রথমটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত অর্থব্যবস্থা, দ্বিতীয়টি সরকার নিয়ন্ত্রিত, তৃতীয়টি আংশিক উন্মুক্ত ও আংশিক সরকার নিয়ন্ত্রিত; শেষোক্ত অর্থব্যবস্থাটি ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত শোষণমুক্ত অর্থব্যবস্থা-যেখানে ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী ভোক্তা ও উৎপাদনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সুতরাং, আমরা দেখতে পেলাম যে, বিভিন্ন অর্থব্যবস্থায় এসব সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা বিভিন্ন রকম।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x