প্রাণিবিজ্ঞান

নিষেক কি, নিষেক প্রক্রিয়া এবং নিষেকের গুরুত্ব ও প্রকারভেদ

1 min read

নিষেক কি এবং কাকে বলে

যৌন জনন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর প্রোনিউক্লিয়াসের মিলন প্রক্রিয়াকে নিষেক বলে। নিষেকের ফলে জাইগোট (Zygote) উৎপন্ন হয়। মূলত নিষেক একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় একটি প্রজাতির হ্যাপ্লয়েড শুক্রাণু (n) ও হ্যাপ্লয়েড ডিম্বাণুর (n) প্রোনিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে ডিপ্লয়েড জাইগোট (2n) সৃষ্টি করে। নিষেকের ফলে ডিম্বাণু সক্রিয় হয় ও জাইগোট পরিস্ফুরণের সূচনা হয়।

নিষেকের প্রকারভেদ

নিষেক সংঘটিত হওয়ার স্থানের ওপর ভিত্তি করে এর প্রকারভেদ নিম্নেবর্ণিত হল।

১. বহিঃনিষেক (External fertilization) : দেহের বাইরে সাধারণত পানিতে যে নিষেক সংঘটিত হয় তাকে বহিঃনিষেক বলে। উদাহরণ- বিভিন্ন জলজ অমেরুদণ্ডী ও কর্ডেট প্রাণীতে বহিঃনিষেক দেখা যায়।

২. অন্তঃনিষেক (Internal fertilization) : যে নিষেক স্ত্রী প্রাণীর জননাঙ্গে সংঘটিত হয় তাকে অন্তঃনিষেক বলে। উদাহরণ-সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ীসহ স্থলে বসবাসকারী প্রাণীদের অন্তঃনিষেক সংঘটিত হয়।

জনন কোষের উৎসের ওপর ভিত্তি করে নিষেকের প্রকারভেদ নিম্নে বর্ণিত হল।

১. স্বনিষেক (Self-fertilization) : উভলিঙ্গ প্রাণীর নিজ দেহে উৎপন্ন শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনকে স্বনিষেক বলে। উদাহরণ- ফিতা কৃমি ও যকৃত কৃমি ইত্যাদিতে স্বনিষেক পরিলক্ষিত হয়।

২. পরনিষেক (Cross fertilization) : একই প্রজাতিভুক্ত ভিন্ন লিঙ্গের প্রাণী থেকে উৎপন্ন শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনকে পরনিষেক বলে। উদাহরণ – মানুষসহ অধিকাংশ প্রাণীতে পরনিষেক ঘটে।

নিষেক প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি

নিষেক একটি ধারাবাহিক জটিল প্রক্রিয়া। বর্ণনার সুবিধার্থে নিষেকের ঘটনাবলি নিম্নোক্ত শিরোনামে বর্ণিত হল।

১. ডিম্বাণুর গাত্রে শুক্রাণুর সংযোগ (Contact of sperm on the surface of ovum) : শুক্রাণু নিঃসৃত এড্রোগ্যামোন হরমোন দু’ধরনের হয়। এই হরমোনের একটি শুক্রাণুর শক্তি সংরক্ষণ করে ও অপরটি ডিম্বাণুর চারপার্শ্বের জিলেটিন আবরণী বিগলিত করে শুক্রাণু প্রবেশে সহায়তা করে। ডিম্বাণু থেকে দুই ধরনের গাইনোগ্যামন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনদ্বয়ের একটি শুক্রাণুর ক্রিয়া বৃদ্ধি করে। এছাড়া অপর হরমোনটি শুক্রাণুর মস্তককে আঠালো করে ডিম্বাণুর গাত্রে সংযুক্ত করতে সহায়তা করে। মূলত নিষেকের জন্য শুক্রাণুকে ডিম্বাণুর সংস্পর্শে আসতে হয়। বিজ্ঞানী Lilac এর মতানুযায়ী ডিম্বাণুর চারপাশের জেলীময় আররণীতে ফার্টিলাইজিন (fertiligin) এবং শুক্রাণুর বহিরাবরণে অ্যান্টিফার্টি লাইজিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। লক এবং কী (Lock & Key) পদ্ধতিতে ফার্টিলাইজিন ও অ্যান্টিফার্টিলাইজিনের মধ্যে সাময়িক বন্ধন সৃষ্টি হওয়ায় শুক্রাণু, ডিম্বাণুর দেহতলে আটকে থাকে। ফার্টিলাইজিন ও এ্যান্টিফার্টিলাইজিন পদার্থ দুই প্রজাতি নির্দিষ্ট থাকে। ফলে এক প্রজাতির শুক্রাণু অপর প্রজাতির ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হতে পারে না।

২. শুক্রাণুর প্রবেশ (Penetration of sperm) : অনেক প্রাণীর ডিম্বাণুতে মাইক্রোপাইল (micropile) নামক ছিদ্র থাকে। এক্ষেত্রে মাইক্রোপাইল ছিদ্র পথে শুক্রাণু প্রবেশ করে। এছাড়া যেসব ডিম্বাণুর মাইক্রোপাইল থাকে না সেক্ষেত্রে শুক্রাণু, ডিম্বাণুর যে কোন জায়গা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। স্তন্যপায়ীদের ডিম্বাণুর করোনা রেডিয়েটা স্তরের ফলিকল কোষগুলি সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ হ্যায়ালুরোণিক এসিড (hyaluronic acid) দিয়ে পরস্পর আটকে থাকে। স্তন্যপায়ীদের শুক্রাণু প্রথমত হ্যায়ালুরোনিডেজ (hyalurondase) উৎসেচকের সহায়তা ডিম্বাণুর করোনা রেডিয়েটা (corona radiata) স্তর ভেদ করে জোনা পেলুসিডা (zona pelucida) স্তরের সংস্পর্শে আসে। অনেক বিজ্ঞানীর মতে- শুক্রাণুর অ্যাক্রোসোম থেকে তৈরি করে। লাইসিন (lysin) নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়ে ডিম্বাণু আবরণী জোনা পেলুসিডা দ্রবীভূত করে শুক্রাণুর প্রবেশ পথ কোন কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় ডিম্বাণুর সংস্পর্শে শুক্রাণু এলেই সংযোগস্থলের বহিঃতলে নিষেক কোন (fertilization cone) তৈরি হয়। এই নিষেক কোণ ফ্যাগোসাইটোসিস (phagocytosis) পদ্ধতিতে শুক্রাণুর মস্তক ও মধ্যভাগ অংশগ্রহণ করে এবং লেজ অংশ পরিত্যক্ত হয়। এভাবে শুক্রাণু গ্রহণের পর নিষেক কোণ অদৃশ্য হয়ে যায়।

শুক্রাণুর প্রবেশ (Penetration of sperm)

৩. নিষেক পর্দা তৈরি (Formation of fertilization membrane) : সাধারণত শুক্রাণুর মস্তক ও মধ্যখণ্ড ডিম্বাণুর ভেতরে প্রবেশ করে। তবে স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শুক্রাণু ডিম্বাণুতে অণুপ্রবেশ করে। এক্ষেত্রে শুক্রাণু প্রবেশের সাথে সাথে ভিটেলিন আবরণী ডিম্বাণুর আবরণী থেকে কিছুটা সরে যায় ফলে দুই আবরণীর মাঝে ফাঁকা পেরিভিটেলিন স্থান (perivitelin space) সৃষ্টি হয়।

নিষেক পর্দা তৈরি

এ পেরিভিটেলিন স্থানে পুনরায় শুক্রাণু প্রবেশে বাধা সৃষ্টিকারী যে আবরণী সৃষ্টি হয় তাকে নিষেক আবরণী বলে। মূলত নিষেক আবরণী সৃষ্টির পর আর কোন শুক্রাণু ডিম্বাণুতে প্রবেশ করতে পারে না।

৪. শুক্রাণুর পরিবর্তন (Changes of sperm) : শুক্রাণুর মস্তক ও মধ্যখণ্ড ডিম্বাণুর ভেতরে অগ্রসর হওয়ার সময় এর অ্যাক্রোসোম অদৃশ্য হয়। শুক্রাণুর মস্তকে ক্রোমাটিন জালিকা সৃষ্টি হয়। এছাড়া মধ্যখণ্ডের সেন্ট্রিওল ও সেন্ট্রোসোম একটি নতুন বিভাজন কেন্দ্র সৃষ্টি করে। এ সময় শুক্রাণুর নিউক্লিয়াসটিকে পুরুষ প্রোনিউক্লিয়াস বলে।

৫. নিউক্লিয়াসদ্বয়ের মিলন বা অ্যাম্ফিমিক্সিস (Fusion of two nucleus or amphimixis) : দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজনের পর ডিম্বাণুর হ্যাপ্লয়েড নিউক্লিয়াসকে স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াস (female pronucleus) বলে। শুক্রাণু ডিম্বাণুতে প্রবেশের পর এর নিউক্লিয়াসকে পুরুষ প্রোনিউনিউক্লিয়াস (male pronucleus) বলে। দুটো প্রোনিউক্লিয়াস এর মিলনকে (fusion) নিউক্লিয়াসদ্বয়ের মিলন বা অ্যাম্ফিমিক্সিস বলে। নিষেকের পর স্ত্রী ও পুরুষ প্রোনিউক্লিয়াসদ্বয় পরস্পরের কাছাকাছি হলে এদের আবরণী অদৃশ্য হয় ফলে ভেতেরর অংশগুলি মিলিত হয়ে একটি পিণ্ড (mass) গঠন করে। অতঃপর একটি সাধারণ আবরণী দ্বারা আবৃত হয়ে জাইগোট নিউক্লিয়াস গঠন করে। জাইগোট নিউক্লিয়াস গঠনের ফলে ডিম্বাণু জাইগোটে পরিণত হয় এবং জাইগোট গঠনের মধ্য দিয়ে নিষেক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে।

নিষেকের ধাপসমূহ

নিষেকে ফলাফল

যৌনজননকারী প্রাণীদের মধ্যে নিষেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে নিষেকের ফলাফল বর্ণিত হল।

  • ১. নিষেকের ফলে জাইগোট গঠিত হয়।
  • ২. নিষেকের মাধ্যমে পুরুষ ও স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে ডিপ্লয়েড নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হয়।
  • ৩. ডিম্বাণুর বিভিন্ন আবরণীর কার্যকারিতা নিষেকের কারণে বৃদ্ধি পায়।
  • ৪. ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমের মধ্যে কুসুমের বিস্তৃতি ও বিন্যাস নিষেকের ফলে পরিবর্তিত হয়।
  • ৫. নিষেকের ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমের মধ্যে ক্রিয়ার ফলে প্রোটিনের ভেদ্যতা, দ্রবণীয়তা ও বিপাক ক্রিয়ার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।

নিষেকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

  • ১. নিষেকের ফলে নতুন জেনেটিক গঠন বিশিষ্ট অপত্যের (ofspring) সৃষ্টি হয়।
  • ২. জীবের ডিপ্লয়েড অবস্থাকে বংশানুক্রমে ঠিক রাখতে নিষেকের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে।
  • ৩. ডিম্বাণুর নির্দিষ্ট মেরুবর্তিতা (polarity) নিষেকের মাধ্যমে স্থাপিত হয়।
  • ৪. নিষেকের দ্বারা জাইগোটে ক্লিভেজের সূচনা হয়।
  • ৫. নিষিক্ত ডিম্বাণুর বিপাক হার ও প্রোটিন সংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি পায়।
  • ৬. নিষেক ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • ৭. নিষেক যেমন জীবের বংশরক্ষা করে তেমনি বংশের ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা প্রদান করে
  • ৮. ভিটেলাইন আবরণী নিষেকের কারণে পৃথক হওয়ায় ডিম্বাণু এর ভেতর ঘুরতে থাকে।
Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x