জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন
আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর রহমতে সকলে ভালো আছেন। আজকে অন্তর প্রশান্তি লাভ করে এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তা হল জিকির। জিকিরের মাধ্যমে অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। আল্লাহ তাআলা জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে কোরআনে এরশাদ করেছেন
(আল কুরআন: আর রা’দ/১৩:২৮)
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
অনুবাদ: যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।
জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে। (আল কুরআন: ২:১৫২)
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ
অনুবাদ: সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।
জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন
لاَ يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ وَلاَ يَزِيدُ فِي الْعُمُرِ إِلاَّ الْبِرُّ ”
সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দু’আ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না এবং সৎকাজ ব্যতীত অন্য কোন কিছুই হায়াত বাড়াতে পারে না। হাসান (সুনানে তিরমিযী ২১৩৯)
উক্ত আয়াত ও হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে জিকির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত যা মৌলিক ইবাদত হিসেবে গণ্য কেননা দোয়াই হলো এবাদতের মূল। তাই আজকে আমরা জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব কোরআন ও হাদিসের আলোকে।
আজকের আলোচনার মধ্যে যা যা থাকছে
- জিকির ও দোয়া কি?
- দোয়া ও জিকিরের মধ্যে পার্থক্য।
- দোয়া ও জিকিরের গুরুত্ব।
- দোয়া ও জিকিরের ফজিলত 15 টি
- দোয়া করার পদ্ধতি।
- দোয়া কবুলের সময়।
- দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ।
- দোয়া কবুলের শর্ত।
আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়লে উক্ত সব বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে পারবেন।
জিকিরের ফজিলত জানার আগে আমরা জানবো
জিকিরের প্রাথমিক ধারণা বা জিকির ও দোয়া কি?
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের কৃত সকল কাজই যিকর হিসেবে বিবেচিত। সলাত, কুরআন তিলাওয়াত যেমন যিকর তেমনি কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন বাক্যও যিকর বা দূ’আ হিসেবে বিবেচিত। ফলে দু’আ ও যিকরের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেছেন, তোমরা আমাকেই স্মরণ (যিকর) কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো। [সূরা বাকারা, ২:১৫২]
যিকর ও দু’আ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই আমাদের সকল ইবাদতের লক্ষ্য। তাই প্রতিটি ইবাদত করার পূর্বে সেই ইবাদত কী, কেন করবো, কিভাবে করবো সে বিষয়গুলো জানা জরুরি। নিম্নে যিকর ও দু’আ কী সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো:
(১) যিকর শব্দের অর্থ স্মরণ করা বা স্মরণ করানো।
(২) দু’আ বলতে আমরা আল্লাহ সাথে কথাবার্তা, প্রার্থনা ও মুনাজাতকে বুঝি। [সহীহ ইবনে খুযাইমাঃ৪৭৪]
(৩) যেকোন প্রকারে মনে, মুখে, অন্তরে, কর্মের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে, আদেশ পালন করে বা নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর নাম, গুণাবলী, বিধি-বিধান, তাঁর পুরস্কার, শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করা বা করানোকে ইসলামের পরিভাষায় যিকর বা আল্লাহর যিকর বলা হয়। [ড খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ), রাহে বেলায়েত, অনুচ্ছেদ-১.৪, পৃ.৪৫)।
(৪) মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন, “তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করিব। [সূরা বাকারা,২:১৫২]
জিকিরের ফজিলত জানার ক্ষেত্রে
দু’আ ও যিকরের মধ্যে পার্থক্য কি তার জানা দরকার।
দুআ এবং যিকর অনেক সময় পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দু’আর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর স্মরণ, তাঁর গুনকীর্তনের পাশাপাশি তার নিজের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করে।
পাশাপাশি অন্য মানুষ বা প্রাণী জগতের কল্যাণও কামনা করা হয়। অপর দিকে আমরা জেনেছি যে, যিকর হলো আল্লাহকে স্মরণ করা।
যিকরে সাধারণত বান্দা আল্লাহর গুণাবলি, মর্যাদা, প্রশংসা ইত্যাদি স্মরণ করে থাকে। যিকরের বহুবচন হলো আয়কার।
যিকর দু’আর অন্যতম প্রকার । বলা যায়, সকল দু’আই যিকর, তবে সকল যিকির দু’আ নয়।
[ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ), রাহে বেলায়েত, অনুচ্ছেদ-১.১৫.১, পৃ.১০৬]
- আরো পড়ুনঃ ফিতরা কার উপর ওয়াজিব
জিকিরের ফজিলত বা দু’আ ও যিকরের গুরুত্ব
দু’আ এবং যিকর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নিম্নে আল কুরআন এবং হাদিসের আলোকে দু’আ ও যিকরের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো, যথা:
(১) মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন, “তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করিব।” [বাকারা: ১৫২]
(২) দু’আ ছাড়া কিছুই তাকদীর পরিবর্তন করতে পারে না। [সুনানে তিরমিযী: ২১৩৯]
(৩) দু’আর মাধ্যমে আসু বিপদ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। [সুনানে তিরমিযী:৩৫৪৮]
(৪) যিকর হলো সর্বোত্তম ইবাদত। [মুসনাদে আহমাদঃ ২২১০৯] (৫) যে নারী ও পুরুষ অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর করে তাদের মুফাররিদ বলে। আর মুফাররিদগণ অন্যদের থেকে অগ্রগামী হয়ে যায়। [সহীহ মুসলিম: ২৬৭৬) (১) আমরা আল্লাহকে স্মরণ (যিকর) করলে আল্লাহ আমাদের স্মরণ করেন; [বাকারা: ১৫২] (২) দু’আ আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও তাঁর আদেশ পালনের বহিঃপ্রকাশ: [আল-আরাফ: ২৯] (৩) দু’আ অহংকার থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যম: [আল-মু’মিন : ৬০] (৬) দু’আ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়; [সুনানে তিরমিযী: [আল-আম্বিয়া: ৯০]
দু’আ ও যিকরের ফজিলত ১৫ টি
আল-কুরআন এবং বিভিন্ন হাদিসের আলোকে দু’আ ও যিকরের ফজিলত বা ১৫ উপকারিতা সূত্রসহ নিম্নে দেয়া হলো:
(৪) দু’আ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত; [সুনানে আবু দাউদ: ১৪৭৯]
(৫) দু’আ আল্লাহর নিকট সবচাইতে সম্মানিত বিষয়: [সুনানে তিরমিযী: ৩৩৭০]
(৭) দু’আ আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ দূর করে; [সুনানে তিরমিযী:৩৫৭১]
(৮) দু’আ বালা মসিবত দূর করে তা আসার আগেই; [সুনানে তিরমিযী: ৩৫৪৮]
(৯) দু’আ বালা মসিবত উঠিয়ে দেয় তা আসার পর; [সুনানে তিরমিযী: ৩৫৪৮] ;
(১০) দু’আ মাজলুম ও দুর্বলদের আশ্রয়স্থল: [আল কাসাস: ২১]
(১১) আল্লাহর আদেশে দু’আর ফল সংরক্ষিত থাকে; [সুনানে তিরমিণী:৩৩৮১।
(১২) মুসলমানদের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি করে; [মারইয়াম: ১৫]
(১৩) দু’আ আল্লাহর মুত্তাকী বান্দাদের বিশেষ এক গুণ;
(১৪) দু’আ দৃঢ়পদ থাকা ও শত্রুদের উপর বিজয়ের মাধ্যম; [আল-বাকারা: ২৫১]
(১৫) দু’আ অক্ষমতা থেকে মুক্তি দেয় এবং বিচক্ষণতার উপর দালালাত করে; [সহীহ ইবনে হিব্বান ৪898]
জিকিরের ফজিলত পরিপূর্ণ পাওয়া যাবে দু’আ করার পদ্ধতি সঠিক হলে।
দু’আ করার সময় নিম্নরূপ বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যায়, যথা:
(১) সর্বদা দু’আ করা যায়; [ আল-হুদ: ৫১]
(২) দু’আতে বেশি বেশি করে চাওয়া উচিত; [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ২৯৯৮২]
(৩) শুধুই মঙ্গল কমনা করা; [সুনানে আবু দাউদ:৩১১৮]
(৪) ফলাফলের জন্য ব্যস্ত না হওয়া; [সহীহ মুসলিম: ২৭৩৫]
(৫) মনোযোগ ও কবুলের দৃঢ় আশা নিয়ে দু’আ করা; [সুনানে তিরমিযী:৩৪৭৯]
(৬) নিজের জন্য নিজে দু’আ করা: [মুসতাদরাক হাকিম: ১৯৯২।
(৭) অন্যের জন্য দু’আর শুরুতে নিজের জন্য দু’আ করা; [সুনানে আবু দাউদ:৩৯৮৪]
(৮) অনপুস্থিতদের জন্য দু’আ করা। [সুনানে আবু দাউদা:৩৯৮৪]
জিকিরের ফজিলত জানার সাথে সাথে দু’আ কবুলের সময় জেনে নেই।
প্রার্থনাকারী যখনই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তখনই আল্লাহ তা’আলা তার ডাকে সাড়া দেন [আল-বাকারা: ১৮৬]। তারপরও
বিশেষ কিছু সময়ে দু’আ কবুল হয় বলে বিভিন্ন হাদিস হতে জানা যায়, যথা: (১) বিশেষত শেষ রাতে; [মুসনাদ আহমাদ: ৯৬৭]
(২) সারারাত: [মুসনাদ আহমাদ : ১৬৭৪] (৩) প্রতি রাতে; [সহীহ মুসলিম:৭৫৭৷
(৪) মধ্যরাত থেকে রাতের শেষ তৃতীয়াংশের শুরু পর্যন্ত; [মুসনাদ আহমাদঃ ১৭৯১২]
(৫) রাতের ১ টা বা ২ টা থেকে বাকি রাত; [সহীহ বুখারী: ১১৪৫১]
(৬) ফরজ নামাযের পর; [মুসনাদ আহমাদ: ৭৫৫১ ]
(৭) আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়: [সুনানে আবু দাউদ:৫২১]
(৮) জিহাদের ময়দানে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে; [সুনানে আবু দাউদ: ২৫৪০]
(৯) সলাতের মধ্যে; [সুনানে আবু দাউদ:২৫৪২]
(১০) শুক্রবারের বিশেষ মুহুর্ত। [সহীহ বুখারী: ৫২৯৪]
ফজিলত জানার পর এবার আমরা জানবো
দু’আ কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ
দু’আ আল্লাহ’র জমিনের যে কোন স্থান থেকেই করা যেতে পারে। আল্লাহ সকল স্থানের দু’আই কবুল করেন। [সহীহ বুখারী : ১৫২১]
তবে কয়েকটি স্থানের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে দু’আ করা হলে তা কবুল করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো হলো:
• বাইতুল্লাহর দরজার কাছে মুলতাযাম
• সাফা ও মারওয়ার উপরে
•তাওয়াফের সময় মাতামে • আরাফাতের মাঠ।
জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম এবারে জানবো
দু’আ কবুলের শর্ত
দু’আ কবুলের অনেক শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিমোনে দেয়া হলো, যথা:
(১) খাদ্য পবিত্র (হালাল) হওয়া; [সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৭],
(২) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে না ডাকা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাহায্য না চাওয়া; [সুনানে তিরমিযী: ২৫১৬]
(৩) রসুল (সা.) প্রদর্শিত পদ্ধতিতে দু’আ করা।
(৪) দু’আর ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা, তাড়াহুড়া দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে বড় বাধা; [সহিহ বুখারীঃ ৬৩৪০; সহিহ মুসলিমঃ ২৭৩৫]
(৫) দু’আর ফল তাৎক্ষণিকভাবে না পেলে উদ্যম হারিয়ে না ফেলা; [সহিহ মুসলিমঃ ২৭৩৬]
(৬) দু’আর মধ্যে পাপের কিছু না থাকা; [সহিহ মুসলিমঃ ২৭৩৬]
(৭) দু’আর মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় না থাকা; [সহিহ মুসলিমঃ ২৭৩৬]
(৮) আল্লাহ্ প্রতি ভাল ধারণা নিয়ে দু’আ করা; [সহীহ বুখারী ৭৪০৫] ; (সহিহ মুসলিমঃ ৪৬৭৫]
(৯) দু’আ কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে আল্লাহ্র কাছে দু’আ করা; [সুনানে তিরমিযীঃ– ] (১০) উদাসীন মনে দু’আ না করে গভীর মনোযোগের সাথে মর্ম অনুধাবন করে দু’আ করা; [সুনানে তিরমিযীঃ ৩৪৭৯]
(১১) দু’আর ক্ষেত্রে কোন সীমালঙ্ঘন না করা; [সূরা আরাফ, আয়াতঃ ৫৫]
(১২). ফরয আমল বাদ দিয়ে দু’আতে মশগুল না হওয়া। যেমন, ফরয নামাযের ওয়াক্তে ফরয নামায বাদ দিয়ে দু’আ করা কিংবা দু’আ করতে গিয়ে মাতাপিতার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা; [—–]
জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে শেষ কথা
জিকির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল যার মাধ্যমে বালা-মুসিবত দূর হয় রিজিকের অভাব দূর হয় এবং সমস্ত সমস্যার সমাধান হয় অতএব আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সকল অবস্থায় সব সময় জিকিরের মাধ্যমে আমল করার মত তৌফিক দান করুন আমীন।