মানুষের জীবনে যতই দিন যাচ্ছে; ততই উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি। সেই সঙ্গে উন্নত হচ্ছে আমাদের জীবনমান। প্রযুক্তির দুনিয়ায় একের পর এক আবিষ্কার চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। কয়েকদিন আগেই গুগল ঘোষণা দিয়েছিল তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোনে থাকবে না আর সিম স্লট। একথা বিস্ময় জাগিয়েছিল অনেকের মনে। তাহলে যোগযোগ হবে কীভাবে? অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ই-সিম (e-Sim) ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তারা।একই সঙ্গে এক থেকে পাঁচটি পর্যন্ত সিম ব্যবহার করা যাবে ই-সিমে। এর জন্য যেমন অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সিমের জায়গা বেচে যাচ্ছে; তেমনই একাধিক সিম কেনার খরচও বাচবে আপনার।
ই-সিম (e-Sim) নামটা অনেকেই হয়তো নতুন শুনতেছেন যদিও এটা বের হইছে অনেক আগেই। বিভিন্ন দেশে এই সিম সেবা চালু রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ও এই সিম সেবা চালু করেছে। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এর দিন ই-সিম (e-Sim) নামে নতুন আরেকটি সিম সেবার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ই-সিম (e-Sim) লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই সবার মাঝে একটা কৌতূহল তৈরী হযেছে যে ই-সিম কি? এটা কিভাবে কাজ করে বা এর সুবিধা অসুবিধা কি? তাই যদি আপনার মনেও একই রকম প্রশ্ন জেগে থাকে এবং ই-সিম (e-Sim) সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আজকের আর্টিক্যালটি আপনার জন্য। বিস্তারিত জানতে সম্পূর্ণ আর্টিক্যালটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
ই-সিম (e-Sim) কী
ই-সিম (e SIM) হচ্ছে এক ধরণের উন্নত প্রযুক্তির সিম বা এমবেডেড সিম । এমবেডেড শব্দটির সুন্দর কোন বাংলা শব্দ পাওয়া যায়নি তাই এই আর্টিক্যালে আমরা তাই এমবেডেড শব্দটিই ব্যবহার করবো।এমবেডেড সিম যদিও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এর মূল কাজ প্রচলিত সিমকার্ডের মতই। সেই হিসেবে আমরা থাকে প্রচলিত সিমকার্ডের প্রতিস্থাপক বা আপগ্রেড ভার্সন বলতে পারি । তবে এর মধ্যে সব থেকে বড় পার্থক্য হচ্ছে প্রচলিত সিমকার্ডের মতো এমবেডেড সিম আলাদা করে খোলা বা লাগানোর কোন সুযোগ নেই। নতুন ই-সিম (e-Sim) এটি প্রচলিত ব্যবহৃত ন্যানো সিমের চেয়েও আরো অনেক ছোট। এটি অন্যান্য সিমের মত নয় এটা একধরণের কানেক্টিং চিপ হিসেবে এটি সাপোর্টেড ডিভাইসের মাদারবোর্ডের সাথে সংযুক্ত করা হয় ডিভাইস তৈরীর সময়ই। তাই এটা খুলা বা লাগানোর কোন সুযোগ থাকছে না।
সেই হিসেবে এটাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল সিমকার্ডও বলা যেতে পারে। ই-সিম (e-Sim) যুক্ত ডিভাইসে আগামীর দিনগুলোতে সাধারণ সিমকার্ড ব্যবহারের মতো কোন স্লট দেওয়া হবে না । তবে সেটা নিয়ে টেনশনের কিছু নেই।কারণ, e-Sim যুক্ত ডিভাইসে সিমকার্ড পরিবর্তন করা না গেলেও আপনি ই-সিমের সাহায্যেই যে কোন অপারেটর এবং নাম্বার পরিবর্তন করার সুযোগ পাবেন । একই সাথে একাধিক নাম্বার বা ডুয়েল সিম একসাথে ব্যবহারের কাজটিও ই-সিমের মাধ্যমে করতে পারবেন। এবং সেটা আরো সহজ হবে বলে জানা যায়।
ই-সিম (e-Sim) ফিজিক্যালি বা দেখতে সাধারণ সিমকার্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুইটা কিন্তু একইভাবে কাজ করবে। অর্থাৎ সাধারণ সিমকার্ড যেভাবে কাজ করে ঠিক একই ভাবে ই-সিম (e-Sim) ও জিএসএম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই কাজ করে।
ই-সিম (e-Sim) এর পূর্ণরূপ কি?
ই-সিম বা এমবেডেড সিম এর পূর্ণরূপ হল এমবেডেড সাবস্ক্রাইবার আইডেনটিটি মডিউল(Embedded Subscriber Identity module)
E= Embedded S= Subscriber I = Identity M = module
তবে ই-সিম (e-Sim) বা এমবেডেড সিম নামেই পরিচিত।
ই-সিম (e-Sim) এর সুবিধাসমূহ
ই-সিম (e-Sim) এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর ফলে বেশ সহজে নেটওয়ার্ক অর্থাৎ মোবাইল অপারেটর পরিবর্তন সম্ভব। অপারেটর পরিবর্তন করতে নতুন একটি সিম কিনে সেটি ফোনে প্রবেশ করানোর কোনো প্রয়োজন হয়না। ই-সিম এর ক্ষেত্রে সিম ইজেক্টর টুল দিয়ে সিম রিমুভ করে নতুন সিম ব্যবহার করতে হচ্ছেনা ই-সিম ব্যবহার করে এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে বেশ সহজে সুইচ করা যাবে। একটি ই-সিমে একই সাথে কমবেশি ৫টি ভার্চুয়াল সিম কার্ড এর তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব। এর মানে হলো নেটওয়ার্ক সিগনাল নেই এমন এলাকায় গেলে সকল সিম থেকে যে সিমের নেটওয়ার্ক আছে, সে সিম ব্যবহার করা যাবে ই-সিম এর কল্যাণে।
বিশেষ করে ভ্রমণের সময় লোকাল নেটওয়ার্কে সুইচ করার ব্যাপারটিকে সহজ করে দেয় ই-সিম। এই ক্ষেত্রে লোকাল সিমে সুইচ করা যাবে ফিজিক্যাল সিম পরিবর্তন না করেই।এক স্লটে একাধিক সিম ব্যবহারের পাশাপাশি ডুয়াল-সিম ফোনসমূহে ই-সিম (e-Sim) এর সাথে চিরাচরিত সিম ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ একই ফোনে একাধিক ফোন নাম্বার ব্যবহারের সুবিধা থাকছে ই-সিম (e-Sim) ব্যবহার করলেও ব্যক্তিগত যোগাযোগে একটি ফোন নাম্বার ও ব্যবসায়িক কাজে আলাদা।
একটি নাম্বার ব্যবহার করতে চাইলে এমন পরিস্থিতিতে বেশ কাজে আসতে পারে ই-সিম।আবার সাধারণ সিম এর চেয়ে ই-সিম (e-Sim) আকারে বেশ ছোটো, যার ফলে ফোনে বাড়তি ফিজিক্যাল স্পেস পাওয়া যায়, আর এই স্পেস স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারারগুলো ব্যাটারি সাইজ বাড়াতে বা নতুন ফিচার যুক্ত করতে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়াও ফোনে যত হোল কম থাকবে, ফোন ধুলাবালি থেকে তত বেশি সুরক্ষিত থাকবে।স্মার্টফোনের সাইজ কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্মার্টওয়াচ এর মতো ছোটো আকারের ডিভাইসসমূহে ই-সিম এর ব্যবহার বেশ সুবিধাজনক হতে পারে। ইতিমধ্যে অ্যাপল তাদের স্মার্টওয়াচ এর বিভিন্ন সিরিজে ই-সিম যুক্ত করেছে। স্যামসাং তাদের স্যামসাং গিয়ার এস২ ও স্যামসাং গিয়ার এস৩ স্মার্টওয়াচে যুক্ত করেছে ই-সিম।
ই-সিম (e-Sim) এর অসুবিধাসমূহ
সকল বিষয়ের সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা ও রয়েছে। ই-সিম (e-Sim) ও তার ব্যতিক্রম নয়। ই-সিম (e-Sim) এর কিছু ডাউনসাইড রয়েছে, যার কারণে এই প্রযুক্তি এখনো মেইনস্ট্রিম হয়নি।প্রথমত শুনতে বেশ সহজ মনে হলেও ই-সিম ব্যবহার করে ডিভাইস সুইচ করা বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। সাধারণ সিমের ক্ষেত্রে ফোন কোনো কারণে কাজ না করলে সিম বের করে তা অন্য ফোনে ইনসার্ট করলে সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেমনঃ ফোন নাম্বার উদ্ধার করা যায়। কিন্তু ফোনের কোনো সমস্যা হলে ই-সিম থেকে তথ্য উদ্ধার করা তেমন সহজ নয়।আপনার গতিবিধি সিম এর সাহায্যে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে, এমন সন্দেহ হলে বেশ সহজে সাধারণ সিম খুলে ফেলা যায়। কিন্তু ই-সিম এর ক্ষেত্রে এমন কোনো সুবিধা নেই। তবে ফোন চুরি হয়ে গেলে ছিনতাইকারীরা কোনো তথ্য মুছতে পারবেনা, এটি একটি ভালো দিক বলা যেতে পারে।
সকল নেটওয়ার্ক কি ই-সিম (e-Sim) সাপোর্ট করে? না, বর্তমানে সকল নেটওয়ার্ক ই-সিম সাপোর্ট করেনা। তবে এই প্রযুক্তি বেশ কিছুদিনের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়াবে।
যেভাবে ই-সিম (e-Sim) ব্যবহার করবেন
আপনি যদি ই-সিম (e-Sim) ব্যবহার করতে চান তাহলে প্রথম যে শর্ত তা হল আপনার ই-সিম সাপোর্টেড ডিভাইস থাকতে হবে এবং ই-সিম (e-Sim) সেবা দেয় এমন কোন মোবাইল অপারেটরের গ্রাহক হতে হবে তাহলে আপনি খুব সহজেই ই-সিম(e SIM) ব্যবহার করতে পারবেন।যেহেতু ই-সিম অন্যান্য সিমের মত ফিজিক্যালি ইনসার্ট করার কোন সুযোগ থাকছে না , তাই আপনার ডিভাইসে ই-সিমকার্ড অ্যাক্টিভ করার পুরো কাজটি করতে হবে বিশেষ একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। তবে চিন্তার কিছু নেই এজন্য আপনার বিশেষ কোন সফটওয়্যার ইন্সটল করা বা কারোর নিকট স্মরণাপন্ন হওয়ার ও প্রয়োজন হবে না ।
ই-সিম (e-Sim) সাপোর্টে সকল ডিভাইসে ই-সিম (e-Sim) সেটাপ করার সফটওয়্যার ম্যানুয়ালি দেওয়া থাকে। ফলে সেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেটিং থেকে খুব সহজেই আপনি নিজে নিজেই ই-সিম সেটাপ করে নিতে পারবেন কোন ঝামেলা ছাড়াই।
আপনি যদি আপনার ডিভাইসে ই-সিম (e-Sim) এক্টিভ করতে চান তাহলে প্রথমে আপনাকে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আপনি আপনার কোন নাম্বার এবং কোন প্ল্যানে ই-সিম (e-Sim) নিতে চান সব কিছু তাদেরকে বিস্তারিত জানাতে হবে। এরপর মোবাইল অপারেটর কোম্পানি আপনাকে কিউআর কোড সম্বলিত একটি কার্ড দিবে যা দিয়ে ই-সিম (e-Sim) অ্যাক্টিভ করতে পারবেন। QR কোড কার্ডের জন্য আপনাকে অতিরিক্ত কিছু টাকা পেমেন্ট করতে হতেও পারে এইসব কিছুই নির্ভর করে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির উপর।যখন আপনাকে ই-সিম অ্যাক্টিভিশনের জন্য কার্ড দেওয়া হবে, তখন সেটাকে শুধু আপনার যে ডিভাইসে এক্টিভ করতে চান ওই ডিভাইসের নির্দিষ্ট সেটিং থেকে QR কোডটি স্ক্যান করে নিতে হবে।
ই-সিম (e-Sim) আছে যেসব ফোনে
বর্তমানে কিছু নির্দিষ্ট স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচে দেখা মিলবে ই-সিম (e-Sim) এর। এসব ডিভাইসসমূহ হলোঃ
- আইফোন ১৩ সিরিজ
- আইফোন ১২সিরিজ
- আইফোন ১০আর
- আইফোন ১০এস ও আইপ্যাড প্রোস্যামসাং এর গ্যালাক্সি এস২১ সিরিজ
- এস২০ সিরিজ,গুগলের গুগল পিক্সেল ৬ সিরিজ
- পিক্সেল ৫ সিরিজ
- পিক্সেল ৪ সিরিজ
- পিক্সেল ৩ সিরিজ
- মটোরোলা রেজার (কোনো সিম ট্রে নেই, শুধু ই-সিম রয়েছে)
- স্যামসাং গিয়ার ডিভাইসসমূহ
- অ্যাপল ওয়াচ সিরিজ ৬
- অ্যাপল ওয়াচ সিরিজ ৫
- অ্যাপল ওয়াচ সিরিজ ৪
- অ্যাপল ওয়াচ সিরিজ ৩
ই-সিম (e-Sim) বা এমবেডডেড সিম নতুন প্রযুক্তি হিসেবে আগামীতে এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে। ই-সিম (e SIM) সম্পর্কে বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছি। আশা করি ই-সিম (e-Sim) কী, এটা কীভাবে কাজ করে এবং ই-সিমের সুবিধা অসুবিধাগুলো সকল কিছুই ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন।
e-sim কি | ই সিম ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা, গ্রামীনফোনের ইসিম, ই সিম কি, ই সিমের সুবিধা, ই সিম বাংলাদেশ, ই সিম সাপোর্ট মোবাইল