পদ্মা সেতু সর্বশেষ খবর I দৈর্ঘ্য কত, বাজেট, বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মানাধীন পদ্মা সেতু একটি বহুমুখী সেতু | সাধারণত একটি দ্বিতল বিশিষ্ট সেতু | যার উপরতলায় সড়ক যোগাযোগ এবং নিচতলায় রেল যোগাযোগ থাকবে |এই সেতু মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হবে | ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সাথে উত্তর পূর্ব অংশের যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটবে | যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতির উপর | বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের জন্য পদ্মা সেতুর মতো একটি বৃহৎ প্রকল্প স্বপ্নের মতো ব্যাপার | যেহেতু পদ্মা সেতু খরস্রোতা তাই এই নদীর উপর এরকম একটি সেতু নির্মাণ করা ছিল চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার| কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এই ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেতুটি নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন |
সেতু নির্মিত হবে স্টিল কনক্রিট দিয়ে |সেতুটির উপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের পার্টিতে থাকবে একটি রেলপথ | 42 টা পিলারের উপর 41 টা স্পেন ইতিমধ্যে বসানো হয়েছে | প্রতিটি স্পেনের দৈর্ঘ্য 150 মিটার | মোট সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে 6.15 কিলোমিটার | সেতুর প্রস্থ 18.10 কিলোমিটার | দেশের সবচেয়ে বড় সেতু | সেতুটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি | প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে 2022 সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে |
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ
প্রকল্পের শুরুতেই অর্থাৎ 2013 সালে প্রকল্পটি উপস্থিতিতে কিছু কথা কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় |বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলশ্রুতিতে অন্নদাতা প্রকল্পটির থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নেয় | পরবর্তীতে এর কোন অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয় | বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার তার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে |
AECOM এর নকশায় পদ্মা নদীর উপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার | তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুতে শুধু সড়কপথ করার কথা ছিল কিন্তু 2011 সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার এতে রেলপথ সংযুক্ত করে | তখন ধরা হয়েছিল 20 হাজার 507 কোটি টাকা | পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও 8 হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় | সব মিলিয়ে এর বেদনা হয় 28 হাজার793 কোটি টাকা| সেতুটির নির্মাণ কাজ 2011 সালের শুরুর দিকে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং এর প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল 2013 সালে।
পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়ন
পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ণ নকশা এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ সেতু প্রকল্প যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।
পদ্মা সেতু নির্মাণব্যয়
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হচ্ছে।
পদ্মা সেতু চুক্তিবদ্ধ সংস্থা
বাংলাদেশ সরকার এবং চিনা মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সাথে 2014 সালের 17 জুন পদ্মা সেতু নির্মাণে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন হয় |পদ্মা সেতু নির্মাণে 2010 সালে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হলে সেখানে 40 টি কোম্পানি অংশ নেয় এবং পাঁচটি কোম্পানিকে বাছাই করা হয় | বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারণে একটি বৃহৎ কোম্পানি বাদ পড়ে যায় | পরবর্তীতে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সাথে চুক্তি হয় এবং তারা 7 ডিসেম্বর 2014 সালে কাজ শুরু করে|
পদ্মা সেতুর ফলে আর্থিক উন্নতি
প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প সম্পন্ন হলে এর মাধ্যমে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সাথে দেশের কেন্দ্র অংশ সরাসরি সংযোগ লাভ করবে |এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় 40 হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের মোট এলাকার 29 শতাংশ অঞ্চল জুড়ে তিন কোটির অধিক জনগণ প্রত্যক্ষ ভাবে উপকৃত হবে|সেতুটিতে রয়েল গ্যাস বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক ক্যাবল সম্প্রসারণ এর ব্যবস্থা রয়েছে | সেতুটি নির্মাণ হলে বাংলাদেশের জিডিপি 1.2 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে|
পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
- ১. পদ্মা সেতুর প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’।
- ২. পদ্মা সেতুর ধরণ দ্বিতলবিশিষ্ট। এই সেতু কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে।
- ৩. পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় (মূল সেতুতে) ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
- ৪. ২০১৭-১৮ অর্থবছর পদ্মাসেতু প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ৫২৪ কোটি টাকা।
- ৫. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন ব্যয় ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
- ৬. পদ্মা সেতু প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড।
- ৭. পদ্মা সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা।
- ৮. পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হবে নিচ তলায়।
- ৯. পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক।
- ১০. পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ .১৫ কিলোমিটার।
- ১১. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ .১৮ কিলোমিটর।
- ১২. পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।
- ১৩. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পাড়ে ১২ কিলোমিটার।
- ১৪. পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় 4000 মানুষ।
- ১৫. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি।
- ১৬. পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা হবে ৬০ ফুট।
- ১৭. পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট।
- ১৮. পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি।
- ১৮. প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং হবে ৬টি।
- ১৯. পদ্মা সেতুর মোট পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৬৪টি।
- ২১. পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
পদ্মা সেতু পিলারের সঙ্গে ফেরির ধাক্কা
২০ জুলাই প্রথম পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ফেরি শাহ মখদুমের তলা ছিদ্র হয়ে যায়। ২৩ জুলাই মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা ফেরি শাহজালাল ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা দিলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।গত ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ১০ নম্বর পিলারে সজোরে ধাক্কা খায়। সর্বশেষ ১৩ আগস্ট সকালে বাংলাবাজার ঘাট থেকে শিমুলিয়া ঘাটে আসার পথে কাকলি নামে একটি ফেরি পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারটিতে আবারও ধাক্কা দেয়।এসব ঘটনায় সেতুর পিলারের পানির লাগোয়া অংশে (পাইল ক্যাপ) পলেস্তারা উঠে গর্তের সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনায় ফেরির মাস্টার ও সুকানিদের বরখাস্ত করা হয়।ফেরি শাহজালালের পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায় বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক আশিকুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।ওই কমিটির আহ্বায়ক তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ তুলে ধরে বলেছিল, পদ্মা সেতুর পিলারগুলোতে পাইলক্যাপ করা আছে, তারপরও পিলারের চারপাশ রাবারের পেন্ডারে বা রাবার দিয়ে মুড়িয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদি কোনো কারণে কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কাও লাগে তবে ধাক্কাটা কম লাগবে। পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
করোনা মহামারির মধ্যেও এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে দিনরাত চলছে নির্মাণযজ্ঞ। দক্ষ শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় প্রকল্পের বিশাল অংশ এখন দৃশ্যমান।