নতুন খামার শুরু করার আগে অবশ্য করণীয় !
১) মন থেকে উত্তর বের করুন গরুর প্রতি অথবা জীবিত প্রাণীর প্রতি আপনার ভালোবাসা আছে কিনা। মাটি ও মানুষের প্রতি আপনি ভিতর থেকে আকর্ষণ অনুভব করেন কিনা। শুধুমাত্র লাভের আশায় কখনো খামার করবেন না। জীবিত প্রাণীর প্রতি মমতা না থাকলে থাকলে আপনি কোনোদিনই খামারী হতে পারবেন না।
২) খামার করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবার ভালো করে ভাবুন, আবার ভাবুন, এরপর আবার। এরপর একটা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি যেটা শুরু করতে চাইছেন সেটার ফলাফল কেমন হতে পারে ভালো করে চিন্তা করুন। অন্যের কথায় কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। নিজের বিবেকবুদ্ধি ও মেধা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিন। মনে রাখবেন শুধুমাত্র ফেইসবুক এর উপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। গরু পালন মোবাইল বা কম্পিউটারে যত সহজ, বাস্তবে এতো সহজ না।
৩) চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে খামারে অভিজ্ঞ কিছু সৎ মানুষ এর সাথে কথা বলুন। আপনার পরিকল্পনা তাদের সামনে উপস্থাপন করুন এবং তাদের মতামত নিন। সবার মতামত নোট করুন এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনে আপনার পরিকল্পনা পরিবর্তন করুন। তাদের কাছ থেকে খামার করার সুবিধা অসুবিধা গুলো ভালো করে জেনে নিন। কোনো প্রকার তাড়াহুড়া করবেন না।
৪) ফোরাম এর নতুন পুরাতন সকল পোস্ট ও কমেন্ট মন দিয়ে পড়েন এবং সেভ করে রাখেন। এখানে অনেক অভিজ্ঞ ভাইদের জ্ঞান ভিত্তিক ও বিষয় ভিত্তিক লেখা এবং ব্যবহারিক মতামত রয়েছে, যা উনারা নিজেদের শ্রম আর মেধা দিয়ে অর্জন করেছেন। কিছু বুঝতে সমস্যা হলে এডমিন সহ অভিজ্ঞ খামারি ভাইদের সাথে কথা বলুন। আপনার সমস্যা সুন্দর করে লিখে পোস্ট করেন। অভিজ্ঞ ও সিনিয়র খামারিদের সন্মান প্রদান করুন এবং তাদের মতামতের এবং সাহায্যের জন্য তাদের সাথে বিনয়ী ব্যবহার করুন। আপনি তাদের সন্মান করলে, আপনিও সমান সন্মান তাদের কাছ থেকে পাবেন। আমাদের ফোরাম এর একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদেশ্য রয়েছে। “পল্লী ডেইরি ফারমার্স” সকল সদস্যকে এবং তাদের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেয় ; তবে নতুন, ক্ষুদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত খামারিদের সুবিধাপ্রদান এবং ‘নিরাপদ খাদ্য’ স্লোগান সামনে রেখে কাজ করে। ফোরাম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অথবা ফোরাম এর সামগ্রিক স্বার্থবিরোধী যেকোনো কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
৫) চুড়ান্ত সিন্ধান্ত নেয়ার আগে আপনার এলাকার দুধের মূল্য কত, গো-খাদ্যের মূল্য কত, কোথায় ঘাস লাগাবেন, কোথায় দুধ বিক্রি করবেন,কোথা থেকে গরু ক্রয় করবেন, কোথায় গরু বিক্রি করবেন, এরকম সব গুলো প্রশ্নের উত্তর মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে খুঁজে বের করুন। আয় ব্যয়ের একটা সম্ভাব্য হিসাব বের করুন। শুধু মাত্র খোলা বাজারের উপর নির্ভর করে বড় বা বেশি গরুর ডেইরি খামার না করাই ভালো। ২/১ দিন দুধ খোলা বাজারে বিক্রি না হলে বা কোম্পানী সংগ্রহ না করলে দুধ নিয়ে বিকল্প কি করবেন চিন্তা করুন।
৬) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কমপক্ষে ৩ জন সফল খামারি এবং ৩ জন ব্যর্থ খামারির সাথে কথা বলুন। যে সফল হয়েছে সে কেন সফল হয়েছে এবং যে ব্যর্থ হয়েছে সে কেন ব্যর্থ হয়েছে, আপনি নিজের মেধা দিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। তাদের প্রত্যেকের খামার পরিচালনা মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন। সফল মানুষ কেন সফল হয়েছে এবং ব্যর্থ খামারি কেন ব্যর্থ হয়েছে তাদের খামার পরিচালনা থেকে উত্তর খুঁজে বের করুন। যে সফল হয়েছে, সে তার সফলতার জন্য যা যা করেছে আপনি সেই কাজ গুলো করতে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা চিন্তা করে দেখুন।
খামার করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে :
৭) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর খামার করার পূর্বে অবশ্যই খামারের উপর সরকারি ট্রেনিং নিয়ে শুরু করবেন। ট্রেনিং মনোযোগ দিয়ে করুন এবং সমস্ত ট্রেনিং মেটেরিয়াল মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং সংরক্ষণ করুন।
৮) নিকটস্থ খামার ভিজিট করেন। যতটা সম্ভব বেশি বেশি খামার ভিসিট করুন। অনুমতি নিয়ে সেচ্ছাসেবক হিসাবে নিজের হাতে অন্যের খামারে কিছু দিন কাজ করুন। মনোযোগ দিয়ে দেখেন তারা কি ভাবে খামার পরিচালনা করে। কি ভাবে গরুর পরিচর্যা করে।
৯) শেড এর ডিসাইন ঠিক করার আগে একাধিক অভিজ্ঞ খামারীকে আপনার শেড দেখিয়ে নিন এবং কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে সংশোধন করে নিন। গরুর জন্য যতটা বেশি সম্ভব আরামদায়ক ঘর তৈরী করুন। সম্ভব হলে গরুর বিচরনের জন্য কিছু খোলা জায়গা রাখুন।
১০) ঘাস লাগানোর জায়গা ঠিক করুন এবং আপনার নির্ধারিত জায়গাতে কোন ঘাস ভালো হবে সেটা ঠিক করে ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা করেন এবং খড় কিভাবে জোগাড় করবেন সেটাও ঠিক করেন। ধান লাগানোর সময় আপনি অ্যাডভান্স খড়ের টাকা দিয়ে রাখলে কম মূল্যে খড় এর ব্যবস্থা করতে পারবেন।
১১) নিকটস্থ থানা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করুন এবং কি কি সুবিধা সেখান থেকে পাবেন তার একটা তালিকা তৈরী করেন। যে সুবিধা গুলো সেখান থেকে পাওয়া যাবেনা সেগুলো কিভাবে ব্যবস্থা করবেন চিন্তা করে বের করুন। যাদের উপর আপনি নির্ভর করবেন তাদের সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখুন এবং ভালো সম্পর্ক তৈরী করুন।
১২) প্রথম অবস্থায় অল্প পরিসরে শুরু করেন। এতে ঝুঁকি কম। শুরুটা ফ্যাটেনিং দিয়ে করতে পারেন। তাহলে অল্পদিনে লাভ সহ মূলধন রিটার্ন পাবেন। ফ্যাটেনিং এর সাথে ২টি গাভিও রাখতে পারেন যাতে খামারের খরচ বাহির থেকে না আনতে হয় এবং একই সাথে অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করতে পারেন।
১৩) গরু কেনার আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গরুর হাটে যাতায়ত করুন এবং গরুর দাম পর্যবেক্ষণ করেন। নিজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরু কেনার চেষ্টা করুন। ফেসবুকে উচ্চমূল্য দেখে গরু কিনবেন না। বাজার দেখে বুঝে, যাচাই বাছাই করে গরু কিনবেন। প্রথমেই খুব বেশি উন্নত জাতের গরু কিনবেন না।যে গরু যত বেশি দুধ দেবে সেটা পালন করাও তত কঠিন হবে। মনে রাখবেন ক্রয়মূল্যের উপর নির্ভর করবে আপনার লাভ।
১৪) প্রতিদিনের একটা কার্যতালিকা তৈরী করুন। প্রতিদিন যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন সেগুলো নোট রাখুন। এই নোট আপনাকে ভবিষ্যতে একই ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে। রোগ বালাই এর জন্য যে ওষুধ গুলো ডাক্তার দেবে সেই ওষুধ এর নির্দেশিকা মন দিয়ে পড়ুন এবং সংগ্রহ করুন। কিছু জরুরি ওষুধ সব সময় আপনার হাতের কাছে রাখুন।কিছু ভেষজ ঔষুধি গাছ আপনার খামারে চাষ করুন যেগুলো আপনাকে অল্প খরচে গরুর চিকিৎসায় সাহায্য করবে। তবে অবশ্যই ব্যবহার প্রণালী জেনে প্রয়োগ করবেন।
১৫)একটা খাদ্য তালিকা সংগ্রহ করুন অভিজ্ঞ খামারিদের কাছ থেকে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন খামারের খরচ কি ভাবে কমাতে পারেন। আপনার খরচ যত কম হবে আপনার লাভ তত বেশি হবে হবে। বাজারের প্রচলিত ফিডের উপর নির্ভরশীলতা কমান। নিজে ভাল রেশন তৈরি করেন। এতে খরচ অনেক কম হবে এবং খাবারের ম্যান ও উন্নত হবে।
১৬) গরুকে মায়ামমতা দিয়ে লালনপালন করুণ। মনে রাখবেন আপনি একজন খামারি, আপনি জীবিত প্রাণীর দেখাশুনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন, কখনো শুধুমাত্র ব্যবসায়ী হবেন না। তবে উদ্দেশ্য হবে যেন খামার থেকে আপনি সর্বোচ্চ লাভ বের করতে পারেন। গরুর প্রতি আপনার ভালোবাসা না থাকলে আপনার খামার কোনোদিন ই লাভজনক হবেনা।
১৭) অন্য খামারিদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখুন এবং তাদের নিয়ে সপ্তাহে একদিন হলেও বসুন এবং সমস্যা এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন। খামার এর লাভ থেকে একটা অংশ প্রতিবেশী গরিব মানুষদেরকে দান করুন। মনে রাখবেন কারো দোআ আপনার খামার এর জন্য না থাকলে আপনি সামনে এগোতে পারবেন না। অধিক লাভের আশায় কোনো প্রকার কৃত্তিম ও ক্ষতিকর পন্থা অবল্বন করবেন না। মুসলিম হিসাবে সময় মতো সালাত আদায় করেন। মুক্তি ভাই বলেন “যে খামারি ফজর এর সালাত জামাতে আদায় করে তার খামারে কখনো লস হয় না”।
আল্লাহ সবার খামারে বারাকাহ দান করুক।