ভৈরব নদীর তীরেই দড়াটানা মোড়। ঐতিহ্যবাহী যশোর শহরের প্রাণ কেন্দ্র। দড়াটানা মোড়ের দড়্গিণ পশ্চিম কোণে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ব্রিটিশ ধাঁচের লাল একটা ভবন। সময়ের ব্যবধানও একে মলিন করতে পারেনি। পাম গাছের সারির পেছনে লাল ইটের গাঁথুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবনটাই এখন যশোর জেলার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যশোর কালেক্টরেট ভবন নামেই বিখ্যাত এটা। শতবছর আগে এখানেই ১৫ টাকা বেতনে খাজাঞ্চির চাকরি করতেন বকচর গ্রামের এক স্বল্পশিড়্গিত যুবক।
১৯১০ সাল। সেই যুবক খালিচোখে হ্যালির ধূমকেতু দেখেন। তারপর অল্পটাকায় একটা বাইনোকুলার কিনে ধূমকেতুটাকে পর্যবেক্ষণ করেন। সেই পর্যবেক্ষণের ফিরিসিত্ম প্রবন্ধ আকারে লিখে পাঠান দ্য হিন্দু পত্রিকায়। সেটা প্রকাশ হয়। এতে তাঁর উত্সাহ আরও বাড়ে, আকাশ পর্যবেক্ষণে মনোযোগী হন। মহাকাশ নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সেগুলো ছাপা হয় কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায়।
তখন শান্ত্মি নিকেতনের বিজ্ঞান শিক্ষক ছিলেন বাংলা সায়েন্স ফিকশনের অন্যতম দিকপাল জগদানন্দ রায়। তাঁর চোখে পড়ে সেই যুবকের লেখাগুলো। তিনি শান্ত্মিনিকেতন থেকে যুবককে চিঠি লেখেন লেখার প্রশংসা করে। সঙ্গে ছিল একটি উপদেশ- যদি একটা দুরবিন কিনে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে ভালো হয়।
এই চিঠি আকাশ পর্যবেক্ষণে যুবকটিকে আরও উসকে দেয়। বকচরে সামান্য কিছু জমি ছিল, সেগুলো বিক্রি করে বিট্রেন থেকে একটা তিন ইঞ্চি ব্যাসের দুরবিন আনান। ১৬০ টাকা দাম, পরিবহন খরচ আরও এক শ টাকার। সেকালে ১৬০ মানে অনেক টাকা, তাঁর প্রায় এক বছরের বেতন! একেবারে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে একখানা মাত্র দুরিবন সম্বল করে শুরু হয় যুবকের মহাকাশ গবেষণা।
যুবকটির নাম রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। বাংলায় মহাকশ পর্যবেক্ষণের অগ্রদূত। জন্ম ১৮৭৮ সালের ১৬ জুলাই, যশোরের বকচর গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই আকাশের প্রতি তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। পর্যবেক্ষণের সুযোগ তো ছিল না। বাবা এক ডাক্তারের সহকারী। সামান্য বেতন। সংসারই চলে না ঠিকমতো। তবু পড়াশোনাটা ঠিকঠাক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষ শেষ করে দশ বছর বয়সে ভর্তি হন যশোর জিলা স্কুলে। কালেক্টরেট ভবনের খুব কাছেই রাধাগোবিন্দের সেই স্কুল আজও টিকে আছে যশোর বোর্ডের সেরা স্কুল হিসেবে।
ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে একটা প্রবন্ধ ছিল- ‘বহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড!’ লেখক অক্ষয় কুমার দত্ত। সেই লেখাটিই ঘুরিয়ে দেয় রাধাগোবিন্দের জীবনের মোড়। সেটাতে খুঁজে পান দূর আকাশের হাতছানী। শুরু হয় আকাশ নিয়ে উথাল-পাথাল ভাবনা আর তারা দেখা। আকাশের প্রেমে এতটায় বিভোর, লেখাপড়া সব শিকেয় ওঠে। তিন তিন বার প্রবেশিকা (এখন যেটাকে এসএসসি বলে) পরীক্ষ দেন। পাশ করতে পারেনি। শেষমেশ পড়াশোনাটাই ছেড়ে দেন। ১৮৯৯ সালে বিয়ের পিড়িতে বসেন। কনে মুর্শিদাবাদের মোহিনী দেবী, নয় বছর বয়স তার মোটে।
বিয়ের পর সংসারে দায়িত্ব কাঁধে চাপে। কিছু একটা করতেই হত। লেখাপড়ার যে দৌড়, ভাল চাকরি জোটবার নয়। তবে অনেক চেষ্টা-চরিত করে কালেক্টরেটের খাজাঞ্চির চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেন মাসিক ১৫ টাকা বেতেনে। সেই বেতনে অতি কষ্টে সংসার চালিয়েও আকাশের খবর ঠিকই রাখেন। সঙ্গে যোগ হয় আইনজীবী কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণা। কালীনাথেরও তারা দেখার বাতিক। শুধু বাতিকই নয়, সংস্কৃত, হিন্দি ও বাংলায় তারা পরিচিতি নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন তিনি। সেকালের সৌখিন আকাশ পর্যবেক্ষদের জন্য বইগুলো ছিল মূল্যবান। কালীনাথের কাছে একটা স্টারম্যাপ বা তারাচিত্র ছিল। সেটা তিনি রাধাগোবিন্দকে দেন। সেই তারাচিত্রটিই পরে রাধাগোবিন্দের আকাশ পর্যবেক্ষক হয়ে উঠতে সহায়ক হয়ে ওঠে।
রাধাগোবিন্দ তারাচিত্রটি নিয়ে রাতে ছাদে উঠে যেতেন। ম্যাপ মিলিয়ে মিলিয়ে চিনে নিতে তারাদের নাম, পরিচয়। একটা ছোট্ট বাইনোকুলার কিনে শুরু হয় আকাশের গভীরে ঢোকার চেষ্টা। এরপর হ্যালির ধূমকেতুর আগমন আর রাধাগোবিন্দের কীর্তিকলাপের কথা তো আগেই বলেছি।
রাধাগোবিন্দ যে দুরবিনটি কিনেছিলেন, সেটা তাঁর হাতে এসে পৌঁছায় ১৯১২ সালে। এরপর জোরকদমে তারা দেখা। তখন ভ্যারিয়েবল স্টারদের নিয়ে গবেষণা চলছিল বিশ্বজুড়ে। ভেরিয়েবল স্টার হলো সেইসব তাঁরা, যাদের ঔজ্জ্বল্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। রাধাগোবিন্দ এই তারাদের নাম দিয়েছিলেন বহুরুপী তারা।
৭ জুন ১৯১৮। রাধাগোবিন্দচন্দ্র আকাশের একটা কোণ যেন বেশিই উজ্জ্বল দেখলেন। এই উজ্জ্বলতার উত্স কী? খুঁজে খুঁজে একটা তারা পেলেন, সেটা উজ্জ্বলতা মাঝে মাঝেই পরিবর্তন হচ্ছে। তারাটার নাম কী? তিনি আকাশের তারাচিত্র নিয়ে তন্ন করে খুঁজেলন, ম্যাপের কোথাও তারাটির হদিস নেই। তার এই স্টার ম্যাপটি খুব বেশি পুরোনোও নয়। তাহলে তিনি কী ভুল কিছু দেখছেন, নাকি নতুন কোনো তারা আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যার সম্পর্কে এখনো পৃথিবীর জ্যোতির্বিদরা জানেনই না! ঠিক তাই, রাধাগোবিন্দ নিশ্চিত হলেন, তিনি নতুন একটা নক্ষত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যেটা একটা ভ্যারিয়েবল স্টার।
রাধাগোবিন্দ তারাটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর খেটেখুটে লিখে ফেললেন একটি প্রবন্ধ। সেটা ছাপা হলো কলকাতার বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকায়। সেটা জগনানন্দের রায়ের চোখে পড়ল আবার। এবার তিনি রাধাগোবিন্দকে চিঠি লিখে জানালেন, তারাটি সম্পর্কে হার্ভার্ড মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। রাধাগোবিন্দ ইংরেজিতে তারাটির বিবরণ দিয়ে পাঠালেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাডে। হার্ভাড মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক তখন হারলো শ্যাপলি। তিনি নিজে একটি অভিনন্দন পাঠালেন রাধাগোবিন্দকে। রাধাগোবিন্দ যে নতুন একটা ভ্যারিয়েবল স্টার আবিষ্কার করেছেন, সেটা নিশ্চিত করে তাকে ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধাও জানান শ্যাপলি। সঙ্গে পাঠান বেশকিছু জ্যোতির্বিদ্যার বই ও আধুনিক তারাচিত্র। সেই ভ্যারিয়েবল স্টারটির বর্তমান নাম নোভা অ্যাকুইলা ৩। এশিয়া মহাদেশে এ কীর্ত্তি তাঁরই প্রথম।
এ ঘটনার পর একের পর ভ্যারিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করেন। সেসব নিয়ে নিবন্ধ ছাপান বিভিন্ন পত্রিকায়। শিগগির তাকে অ্যামেরিকান অ্যাসোসিয়েন অব ভ্যারিয়েবল স্টার’স অবজাভার-এর সদস্য করা হয়। তিনি এই সংস্থাটির প্রথমদিকের আন্তর্জাতিক সদস্যদের একজন। ১৯২৬ সালে জ্যোতির্বিদ চার্লস এলমার এই সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি ৬ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপ পাঠান। অবসরের আগ পর্যন্ত এই টেলিস্কোপটিই তাঁর সঙ্গী ছিল।
১৯২৮ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের অন্যতম বেসামরিক খেতাব অফিসার্স অ্যাকাডেমিক অব রিপাবলিকান ফ্যান্সিসে ভূষিত করে। ফ্র্যান্সের ভেরিয়েবল স্টার অবজার্ভেশন সংস্থা (এএফওইভি)র সদস্য করে নেওয়া হয়। সদস্য করা হয় ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনেরও।
১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাধাগোবিন্দ ৩৭ হাজারেরও বেশি ভেরিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও রাধাগোবিন্দ চন্দ্র বাংলাদেশে ছিলেন। এরই মধ্যেই চাকরি থেকে অবসরে যান। কিন্তু পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে বাধা গোল। যশোর কালেকটরেটের কোনও এক কর্মকর্তার সঙ্গে ঝামেলা। তিনি পেনশন না নিয়েই চলে আসেন। অনেকটা অভিমান নিয়ে দেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে চলে যান তিনি ১৯৬০ সালে। শেষদিকে অভাব-অনটনে ভুগছিলেন, ভারতে স্থায়ী হওয়ার পর অভাব জাঁকিয়ে বসে। তার মধ্যেও জাগ্রত ছিল তাঁর মহাকাশ গবেষণা