পদার্থ বিজ্ঞানে বল (Force) সম্পর্কে অনেক শুনেছি এবং জেনেছি। আজ বল সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানবো ।
বল অনেক ধরনের হয়ে থাকে যেমন: ঘর্ষনবল, স্পর্শবল, টানাবল, সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট বল ইত্যাদি । বল এমন এক ধরনের বাহ্যিক প্রভাব যা কোনো স্থির বস্তুকে গতিশীল করে এবং গতিশীল বস্তুকে তার পূর্বের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য করে।
বল কাকে বলে?
বলের সংজ্ঞাঃ
যে বাহ্যিক কারণের জন্য কোনো স্থিতিশীল বস্তু গতিশীল হয় এবং তার অবস্থান পরিবর্তন হয়, তখন সেই বাহ্যিক কারণকে বলা হয় বল।
বলের বৈশিষ্ট:
১। কোনো স্থির বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল সেই স্থিতিশীল বস্তুকে গতিশীল করতে পারে। অর্থাৎ বল ত্বরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
২। বল সবসময় জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়া করে। অ দুটি বস্তুর মধ্যে যদি কিংবা না হয় তাহলে বল হয় না।
৩। কেনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে গতিশীল বস্তুর বিকৃতি ঘটতে পারে অথবা বস্তুর বেগ হ্রাস অথবা বৃদ্ধি পায়।
৪। একটি গতিশীল বস্তুর বেগ তথা গতি যেদিকে থাকে, বল প্রযুক্ত করা হলে সেই গতি তথা বল পরিবর্তন হয়ে যায়।
বলের এককঃ
বলের এফ.পি.এস একক পাউন্ডাল এবং
এস.আই পদ্ধতিতে বলের একক নিউটন।
মাত্রাঃ
বলের মাত্রা, [F] =[MLT-2]
বলকে সাধারণত F দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
m ভরের কোনো বস্তুর উপর F বল প্রয়োগ করা হলে ত্বরণ a সৃষ্টি হয়,
F = ma
অর্থাৎ ত্বরণ এবং ভরের গুণফল দ্বারা বল পরিমাপ করা হয়।
বলের প্রকারভেদ
Kinds of forces
প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের বল রয়েছে। এই বল গুলোর সাথে প্রায় আমরা সবাই পরিচিত। এই বল গুলোর আবার বিভিন্ন নামকরণও রয়েছে। এই সবগুলো বলের আলাদা নাম থাকলেও সবগুলো কিন্তু মৌলিক বল নয়।
মৌলিক বলঃ
যে সকল বল অকৃত্তিম বা মূল অর্থাৎ যে বল অন্য বল থেকে উৎপন্ন হয় না বরং অন্যান্য বল এই সকল বল থেকে উৎপন্ন হয়, তাদেরকে মৌলিক বল বলে।
মৌলিকতা অনুসারে প্রকৃতিতে চার ধরনের বল আছে।
মৌলিক বলগুলো হলো:
১। মহাকর্ষ বল ( Gravitational force )
২। তড়িৎ – চুম্বকীয় বল ( Electromagnetic force )
৩। সবল নিউক্লীয় বল ( Strong nuclear force )
৪। দুর্বল নিউক্লীয় বল ( Weak nuclear force )
১। মহাকর্ষ বল : মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ বল ক্রিয়াশীল রয়েছে । এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলা হয় । এই বলের পরিমাণ ক্রিয়াশীল বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক । বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে বস্তুদ্বয়ের মধ্যে গ্রাভিটন ( Graviton ) নামক এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের দ্বারা এই মহাকর্ষ বল ক্রিয়াশীল হয় । মহাকর্ষ বল মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল নয়।
২। তড়িৎ-চুম্বকীয় বল: দুটি আহিত বা চার্জিত বস্তুর মধ্যে এবং দুটি চুম্বক পদার্থের মধ্যে এক ধরনের বল ক্রিয়াশীল থাকে । এদেরকে যথাক্রমে কুলঘের তড়িৎ এবং চৌম্বক বল বলা হয় । চৌম্বক বল এবং তড়িৎ আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় ধরনের হতে পারে । তড়িৎ এবং চৌম্বক বল আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় ধরনের হতে পারে । ধারণা করা হয় যে , মূলত চার্জহীন এবং ভরহীন ফোটন নামক এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই বল কার্যকর হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়া, আণবিক গঠন , স্থিতিস্থাপক বল ইত্যাদিতে চুম্বকীয়- তড়িৎ বলের প্রকাশ ঘটে।
নিউক্লীয় বল
৩। সবল নিউক্লীয় বল : প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস। এদেরকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় নিউক্লিয়ন ( Nucleon ) বা ভর বলে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে সমধর্মী ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটনগুলো খুব কাছাকাছি থাকায় এদের মধ্যে কুলঘের বিকর্ষণ বল প্রবল হওয়া উচিত এবং নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে যাওয়ার কথা । কিন্তু বাস্তবে অনেক নিউক্লিয়াসই স্থায়ী । নিউক্লিয়নের মধ্যে যে মাধ্যাকর্ষণ বল কাজ করে তা এত নগণ্য যে এই বল কুলঘের বিকর্ষণ বলকে প্রতিমিত (balance) করতে পারে না । সুতরাং নিউক্লিয়াসে অবশ্যই অন্য এক ধরনের সবল বল কাজ করে যা নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখে । এই বলকে বলা হয় সবল নিউক্লীয় বল । বিজ্ঞানীদের ধারণা যে নিউক্লিয়নের মধ্যে মেসন ( Meson ) নামে এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের দ্বারা এই বল ক্রিয়াশীল হয় । এই বল আকর্ষণধর্মী , স্বল্প পাল্লা বিশিষ্ট (short range) , চার্জ নিরপেক্ষ এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে ক্রিয়াশীল নয়।
৪। দুর্বল নিউক্লীয় বল : প্রকৃতিতে বেশ কিছু মৌলিক পদার্থ ( elements ) রয়েছে যাদের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে যায় ( যেমন ইউরেনিয়াম , থােরিয়াম ইত্যাদি ) । এই সমস্ত নিউক্লিয়াসকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে তিন ধরনের রশ্মি বা কণা নির্গত হয় যাদেরকে আলফা রশ্মি (α-rays ) , বিটা রশ্মি (β-rays ) এবং গামা রশ্মি (𝛾- rays ) বলা হয়। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা কণা নির্গত হওয়ার সময় একই সাথে শক্তিও নির্গত হয় । তবে পরিক্ষালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ বিটা কণার গতিশক্তির চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রশ্ন ওঠে যে |
বিটা-কণা যদি শক্তির সামান্য অংশ বহন করে, তবে অবশিষ্ট শক্তি কোথায় যায়?
1930 সালে ডব্লিউ. পাউলি (W. Pauli ) প্রস্তাব করেন যে অবশিষ্ট শক্তি অন্য এক ধরনের কণা বহন করে যা বিটা-কণার সঙ্গেই নির্গত হয়।
এই কণাকে বলা হয় নিউট্রিনো (neutrino)।
এ নিউট্রিনো কণা এবং বিটা-কণার নির্গমন চতুর্থ একটি মৌলিক বলের কারণে ঘটে, যাকে বলা হয় দুর্বল নিউক্লীয় বল।
এই দুর্বল নিউক্লীয় বল সকল নিউক্লীয় বা তড়িৎ চুম্বকীয় বলের তুলনায় অনেকটা দুর্বল।
এই দুর্বল নিউক্লীয় বলের কারণে অনেক নিউক্লিয়াসের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া দ্রুত সংঘটিত হয় ।
ধারণা করা হয়, বোসন নামক এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই দুর্বল নিউক্লীয় বল কার্যকর হয়।
মৌলিক বলসমূহের তীব্রতার তুলনা
চারটি মৌলিক বলের পরিমাপের সবলতা তুলনা করলে দেখা যায় যে সবচেয়ে দুর্বল বল হলো মহাকর্ষ বল এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বল হচ্ছে সবল নিউক্লীয় বল ।
সবল নিউক্লীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল উভয় ধরনের নিউক্লীয় বলের ক্লিয়ার পাল্লা ( range ) খুবই স্বল্প ( very short ) ।
এগুলো শুধু নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল হয়। তবে কখনও নিউক্লিয়াসের পৃষ্ঠের বাইরে ক্রিয়াশীল হয় না।
অন্যদিকে তড়িৎ-চুম্বকীয় এবং মহাকর্ষ বলের পাল্লা প্রায় অসীম।
এই চারটি মৌলিক বলের আপেক্ষিক সবলতা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা লাভের জন্য আমরা ধরে নিতে পারি সবল নিউক্লীয় বলের মান 1, এক্ষেত্রে দুর্বল নিউক্লীয় বল , মহাকর্ষ বল এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের আপেক্ষিক স্বলতার মান হবে যথাক্রমে 10-12 ,10-39 ,10-2 ।
চারটি মৌলিক বলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিজ্ঞানীরা বহু বছর থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
প্রফেসর আব্দুস সালাম , ওয়াইনবার্গ ও গ্লাসো এই তিনজন বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন গবেষণা করে দুর্বল নিউক্লীয় বল এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন যা সালাম-ওয়াইনবার্গের তত্ব নামে পরিচিত।
বলের সঙ্গামূলক ধারণা
১। একটি ফুটবলকে কিক মারলে তা সহজেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। তবে একই আকৃতির লোহার বলকে কিক করলে ফুটবলের মতো অগ্রসর হয় না।
২। একটি নির্দিষ্ট বেগে চলন্ত সাইকেল কে সহজেই আটকানো সম্ভব। তবে একটি জেট প্লেন কে কোনো ভাবেই সনভব নয়।