বাংলা ভাষার গৌরব গাঁথা ইতিহাস
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরের স্মৃতি। শুনিয়ে যায় মনে শিহরণ জাগানো এক গান ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। বাঙালির মনে বেজে ওঠে শোকগাঁথা এক করুণ সুর, আমাদের ভাই হারানোর গান।সাথে গর্বে বুক ফুলে ওঠে সেই শোকের চাইতেই বেশি। আমরা আমাদের বাংলা ভাষার অধিকার আদায় করে নিয়েছি আমার ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে, এটা অবশ্যই গৌরবের। এজন্যই একুশের চেতনা বয়ে চলুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি কি তাদের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেকে দিয়েছিল ভাষার জন্য! বাঙালি দিয়েছিল বলেই বিশ্ব দরবারে বুক চিতিয়ে বলতে পারি ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’!
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতির ওপর যে আগ্রাসন চালিয়েছিল তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।
দেশভাগের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হওয়া সত্বেও পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করে তা বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রহসন চলতে থাকে, তা লড়াকু বাঙালি কখনোই মেনে নেয়নি।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাঙালি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সভা ওয়াকআউট করে চলে আসেন।
বাঙালি ছাত্র সমাজে বইতে থাকে প্রতিবাদের ঝড়।গড়ে উঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা ও জোর পূর্বক বাঙালিদের মায়ের মুখের ভাষা হরণ করার ঘোষণা বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মনে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অব্যক্ত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এখানে ঘুরে আসুন
১৪৪ ধারা জারি
পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ এমন আকস্মিক ও অন্যায্য সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। চারিদিকে বইতে থাকে প্রতিবাদের ঝড়। গড়ে ওঠে কঠোর আন্দোলন। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
আন্দোলন দমনে ঢাকা শহরে মিছিল, সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অব্যক্ত ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানুন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্ণরের সরকারী আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেল কলেজের অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন এবং রাস্তা প্রদক্ষিণ করতে থাকেন।
এতে কিছু সংখ্যক সাধারণ মানু্ষও যোগদান করেন।
মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নিহত হোন অনেকেই। এছাড়াও আরও ১৭ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হোন।
শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায়। হানাদারদের বর্বর হামলার এই খবর সারাদেশে বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং বাঙালিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মিছিলে হামলা করে সাধারণ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ সারাদেশে হরতাল পালন করে।
২২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হোন শফিউর রহমান , রিক্সাচালক আউয়াল ও এক কিশোর। রক্তে রঞ্জিত হতে থাকে বাংলার রাজপথ।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজে হোস্টেলে রাতারাতি নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার।
যা পরের দিন শহীদ শফিউরের পিতা উদ্বোধন করেন। একদিন না যেতেই পুলিশ সেই শহীদ মিনারও ভেঙ্গে ফেলে।
তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।
রক্তের বিনিময়ে বাঙালি লাভ করে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালির প্রচেষ্ঠায় ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, জীবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
তারপর থেকে সারা বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
যা বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও মর্যাদার।
ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে যারা বাংলাকে সারাবিশ্বের বুকে অত্যন্ত গর্ব ও মর্যাদার আসনে আসীন করে গিয়েছেন তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আমাদের শুধুমাত্র ২১ শে ফেব্রুয়ারিতেই সীমাবদ্ধ। যা অত্যন্ত লজ্জার ও হতাশার একটি বিষয়।
শুধুমাত্র ২১ শে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা আমাদের মাতৃভাষার প্রতি বিস্তর ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করি। কিন্তু আমাদের সারাবছরের কাজকর্মে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়না।
বাংলাভাষা নিয়ে আমাদের আবেগের প্রকাশ ঘটতে পারতো আমাদের সামগ্রিক জনজীবনে। শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই এখন বিদেশী ভাষা আর সংস্কৃতিতে ছেয়ে গেছে।
অথচ যেই ভাষার অধিকার আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করলাম তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন তো দূরে থাক, বরং আরও অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়ে থাকে আজকাল। আমরা বিদেশী ভাষা, সংস্কৃতি জানাকে বর্তমানে যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করি, অথচ বাংলাকে দেখি অবজ্ঞার চোখে।
শুধুমাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই কেন আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে? রক্ত দিয়ে অর্জিত ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে সর্বক্ষেত্রে, সবসময়ই।
ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর হয়ে গেলেও বাংলা ভাষার প্রতি, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারিনি। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।
বাংলাভাষার সার্বজনীন প্রচলন ও ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা না গেলে সারাবিশ্বে রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষার যে মর্যাদা তা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভবপর হবেনা।
নিজের ভাষাকে উপেক্ষা করে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার যে মহা আয়োজন বর্তমানে চলছে সেই প্রক্রিয়া থেকে আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।
বাংলা ভাষার অবমাননা
সেই সাথে শিক্ষা, শিল্প,সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সিনেমাসহ সকল ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্বতা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।
বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অবমাননা যেন একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের যুবসমাজ বাংলাকে বিভিন্ন ভাষার সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ে যে অগ্রহণযোগ্য ধারার প্রচলণ করেছে তা বাংলাকে করুণভাবে অপমানিত করে চলেছে।
বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাব ও আমাদের উদাসীনতা বর্তমানে বাংলা ভাষার অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।
প্রমীত বাংলা চর্চায় আমাদের অনীহা ও বিদেশী ভাষার প্রতি আমাদের অনুরাগ আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান সময়ের করুণ অবস্থার অন্যতম কারণ হিসবে দাঁড়িয়েছে। এখনই এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার যথাযথ সম্মান রক্ষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য সার্বজনীন বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সেই সাথে শুদ্ধ ও প্রমীত বাংলা ব্যবহারে সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।
এ বিষয়ে আমাদের তরুণ সমাজেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বাংলাকে বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন যেসব ভাষা শহীদেরা।তাদের প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
তাদের পরিবারের সদস্যদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ভাষার প্রতি, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি আবগের বহিঃপ্রকাশ সর্বক্ষেত্রেই দেখাতে হবে। তবেই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা সহজতর হবে।
বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা ও প্রমীত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতই হোক আমাদের এই মহান ভাষার মাসের অঙ্গীকার। বাংলাভাষা বিশ্বের বুকে সম্মানের সহিত অধিষ্ঠিত থাকুক চিরকাল।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রমীত বাংলা বয়ে চলুক যথাযথ সম্মানের সাথে এটাই প্রত্যাশা।