কখনও কি বৈদ্যুতিক শক খেয়েছেন? অনেকেই মনে করেন যে বৈদ্যুতিক শকের দিক থেকে ডিসি কারেন্ট এসি কারেন্টের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বিপজ্জনক। কোনটি আরও বিপজ্জনক তা খুঁজে বের করতে আসুন এসি কারেন্ট এবং ডিসি কারেন্টের বেসিকগুলি দেখে নেই।
এসি কারেন্ট (AC Current)
অলটারনেটিং কারেন্ট বা AC Current সাইন ওয়েভের সাহায্যে (উপরের ছবিতে) দেখানো হয়েছে। সাইন ওয়েভ থেকে আমরা জানি এটি বার বার উপরের প্যাটার্ন মেনে চলে। অর্থাৎ সময়ের সাথে প্রতিনিয়ত বাড়ে কমে। নির্দিষ্ট পর্যায়কাল পর পর এটি বিপরীত ধর্ম প্রদর্শন করে অর্থাৎ একবার পজিটিভ হয় আরেকবার নেগেটিভ হয়। আমরা আমাদের পারিবারিক সরঞ্জাম যেমন লাইট, ফ্যান ইত্যাদিতে সাধারণত এসি কারেন্ট ব্যবহার করে থাকি।
ডিসি কারেন্ট (DC)
ডিরেক্ট কারেন্ট বা DC Current সবসময় একইদিকে প্রবাহিত হয় এবং সময়ের সাথে সাথে কারেন্টের মান পরিবর্তন হয়না। এটি ছোট ছোট বৈদ্যুতিক সার্কিট, ব্যাটারি ইত্যাদিতে দেখা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শুধুমাত্র কারেন্টের ধরনের উপর নির্ভর করে বৈদ্যুতিক শকের তীব্রতা পরিমাপ করতে পারবেন না। শকের মান কেমন হবে তার জন্য আরো কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে। চলুন এবার সেগুলো জেনে ফেলিঃ
কারেন্টের পরিমান
আপনার শকটি কেমন হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে কারেন্তের পরিমানের উপর। অর্থাৎ ঠিক কি পরিমান কারেন্ট আপনার শরীরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তার উপর। মোটামুটি ১৫ থেকে ২০ মিলি এম্পিয়ারের অল্টারনেটিং কারেন্টের বৈদ্যুতিক শক আপনার জন্য ব্যথাদায়ক হতে পারে। তবে ১০০ মিলি এম্পিয়ারের একটি AC Current শক কিন্তু আপনার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
কারেন্টের পথ
কারেন্টের গতিপথের উপরও আপনার শকের ভয়াবহতা অনেকাংশে নির্ভর করে। কারেন্ট যদি ডানহাত দিয়ে প্রবেশ করে ডান পা দিয়ে মাটিতে যায় সেক্ষেত্রে শকটি আপনার জন্য বেশি মারাত্মক হবে। তবে যদি কোন কারনে কারেন্ট ডান হাত দিয়ে ঢুকে হার্ট হয়ে বাম হাত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় তবে আপনার ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেশন হতে পারে যা আরও বেশি মারাত্মক।
কারেন্ট প্রবাহের সময়কাল
সামান্য পরিমাণ কারেন্টও যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় তাহলে আপনি বৈদ্যুতিক শক অনুভর করতে পারেন। কারণ ০.৩ মিলিঅ্যাম্পিয়ার এর মত বিদ্যুৎ প্রবাহও আপনার শরীরে অস্বস্থি তৈরি করে ফেলতে পারে যদি সেটা বেশিক্ষন ধরে প্রবাহিত হয়।
শরীরের রোধ
সাধারণত শুষ্ক শরীরের তুলনায় ভেজা শরীরে বৈদ্যুতিক শক বেশি অনুভুত হয়। যেহেতু মানুষের শরীরের বৈদ্যুতিক রোধ এর কোনো নির্দিস্ট মান নেই। এটি অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তাই একেকজনের দেহে শকের পরিমাণও একেক রকম হবে। মানবদেহে এই রোধের পরিসর ৫০০ ওহম থেকে ১০০,০০০ ওহম পর্যন্ত হতে পারে।
এবার আসি মূল কথায়। মানুষ কেন শক খায়?
মানুষ কেন বৈদ্যুতিক শক খায়?
এটি জানতে বেশ আশ্চর্য লাগবে যে, কারেন্ট ত্বকের মাধ্যমে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে। ত্বকের এপিডার্মিসের বাইরেরতম স্তরটি কেরাটিন নামক একটি প্রোটিন উপাদান দ্বারা গঠিত।
কেরাতিন এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সহজে যেতে পারেনা কারণ কেরাতিন এর জন্য শরীরে অত্যধিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এপিডার্মিস স্তরের পরে থাকে আমাদের ঘাম গ্রন্থি এবং তারপরে রক্তনালীগুলি থাকে। এই ঘাম গ্রন্থি এবং রক্তনালীগুলি বিভিন্ন আয়নের সমন্বয়ে গঠিত, যা একটি ভাল বিদ্যুৎ পরিবাহক। যার ফলে সহজেই বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কারেন্ট কীভাবে শরীরের মধ্যে ঢূকে এবং চলাচল করে।
উপরের প্রশ্নের উত্তর থেকে আমরা জানি, ত্বকের এপিডার্মিসের বহিরাগত স্তরটি একটি ডাইলেট্রিক হিসাবে কাজ করে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ ঘাম গ্রন্থি এবং টিস্যুগুলি ক্যাপাসিটরের প্লেট হিসেবে কাজ করে। এই ক্যাপাসিটিভ-এফেক্টের কারণে কারেন্ট মানুষের শরীরের মধ্য দিয়ে যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল ভোল্টেজ শরীরের মধ্য দিয়ে আরও বেশি কারেন্ট প্রবাহের সু্যোগ দেয়।
এসি এবং ডিসির মধ্যে কোনটি বেশি বিপজ্জনক?
এখন আমি AC Current এবং DC Current উভয়ের পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করব যেগুলো মানুষ (পুরুষ এবং মহিলা সহ) এবং শিল্প পেশাদারদের উপর চালিত পরীক্ষাগুলির উপর ভিত্তি করে লেখা। যাদের উভয় প্রকার কারেন্ট সম্পর্কে ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ডিসি কারেন্টের পক্ষে যুক্তি
ডিসি কারেন্টের সাহায্যে বৈদ্যুতিক শক পেয়েছেন এমন ভুক্তভোগীরা বলেছেন যে ডিসি কারেন্ট অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হওয়ায় অর্থাৎ সময়ের সাথে কারেন্ট এবং ভোল্টেজের মান পরিবর্তন না হওয়ায় তারা তাদের হাত পিছনে টানতে পারেন না। এই প্রভাবটি ডিসি কারেন্ট সরবরাহ করা বৈদ্যুতিক ডোর বেলের অনুরূপ। সুতরাং, এটি সহজেই বলা যায় DC Current যথেষ্ট শক্তিশালী এবং বিপজ্জনক।
অন্যদিকে, এসি কারেন্টের ক্ষেত্রে, বৈদ্যুতিক শক সম্মুখীন ব্যক্তি কারেন্টটি শূন্যের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের হাত পিছনে টানতে পারে। সুতরাং, এটি বিশ্বাস করা হয় যে এসি কারেন্ট শক ডিসি কারেন্টের চেয়ে কম বিপজ্জনক।
এসি কারেন্টের পক্ষে যুক্তি
এসি কারেন্টের সাহায্যে বৈদ্যুতিক শক পেয়েছেন এমন ভুক্তভোগীদের মূল চিন্তাই হল জীবন বাঁচানো এবং এটা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং জীবন বাঁচানো। এক্ষেত্রে পেশীগুলির অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা জানা যায় না।
পুরুষ ও মহিলাদের উপর চার্লস ডালজিয়েল এর পরীক্ষাগুলি অনুসারে জানা যায়, ডিসি কারেন্টের সাথে বৈদ্যুতিক শক হওয়ার ক্ষেত্রে পেশীগুলির সংকোচন অবিরত চলতে থাকে। যেখানে এসি কারেন্টের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক অনুভব করা ব্যক্তির মধ্যে পেশী সংকোচনে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। অনিয়মিত পেশী সংকোচনের কারণে পেশীগুলির মারাত্মক ক্ষতি হয়।
ত্বকের ক্যাপাসিটিভ আচরণের কারণে, ভোল্টেজ দ্রুত পরিবর্তিত হলে আরও বেশি কারেন্ট শরীরে প্রবেশ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ভোল্টেজের দ্বিগুণ বৃদ্ধি হলে Current সাতগুণ সাত গুণ বৃদ্ধি পায়! (এরপর তো আর এসির শক্তি নিয়ে কোন কথা বলা চলে না)। একারণে এসি কারেন্টের মতো একই প্রভাব তৈরি করতে আরও বেশি পরিমান ডিসি কারেন্টের প্রয়োজন।
এখন, সব দিক বিবেচনা করা বলা যায় যে, এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্টের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। তাই বলে বিদ্যুতের ভয়ে ভীত হওয়া যাবেনা।
তবে আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এসি কারেন্ট এবং ডিসি কারেন্ট যাই হোক না কেন উভয়ই মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই Current নিয়ে কাজ করার সময় নিজের সুরক্ষার বিষয়টি যত্নসহকারে দেখা উচিৎ।