সমাজ বিজ্ঞান কাকে বলে? সমাজবিজ্ঞানের জনক কে? | সমাজবিজ্ঞানকে কেন বিজ্ঞান বলা হয়

সমাজ বিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Sociology. এটি ল্যাটিন শব্দ Socious এবং logos থেকে এসেছে। Socious শব্দটির অর্থ হলো সমাজ (Society), আর logos অর্থ বিজ্ঞান (Science). সুতরাং Sociology শব্দটির অর্থ হলো সমাজের বিজ্ঞান। আজকে আমরা সমাজ বিজ্ঞান কাকে বলে এবং সমাজবিজ্ঞানের জনক কে তা জানব।

সমাজ বিজ্ঞান কাকে বলে?

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তাদের সমষ্টিগতভাবে থাকাকে সমাজ বলে। আর এই সমাজ নিয়ে বিশেষ জ্ঞান বিজ্ঞান কে সমাজবিজ্ঞান বলা হয়।

সমাজ বিজ্ঞান হলো মানুষের সমাজ বা দলের বৈজ্ঞানিক আলোচনা শাস্ত্র। এখানে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের সামাজিক দিক এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজের মতে, “সমাজবিজ্ঞান হলো সামাজিক সম্পর্কের আলোচনা।”

Hob House বলেন, ” The subject matter of sociology is the interaction of human mind.”

N.L. Word এর মতে, ” সমাজবিজ্ঞান হলো সামাজের বিজ্ঞান এবং অগ্রগতির সামাজিক প্রেক্ষাপট।”

 সমাজবিজ্ঞান মানুষের সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের বিজ্ঞান । মানুষের দলগত আচরণ ও পারস্পরিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানে আলোকপাত করা হয় ।

সমাজবিজ্ঞান : যে শাস্ত্র সমাজের মানুষের উৎপত্তি , ক্রমবিকাশ , আচার আচরণ , রীতিনীতি , ধ্যানধারণা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে সমাজবিজ্ঞান বলে ।

শাব্দিক বিশেষণ : ল্যাটিন শব্দ Socious এবং গ্রিক শব্দ Logos এর সমন্বয়ে ইংরেজি Sociology শব্দের উৎপত্তি । ‘ Socious ‘ শব্দের অর্থ সমাজ আর ‘ Logos ‘ শব্দের অর্থ জ্ঞান । Sociology শব্দের অর্থ সমাজের জ্ঞান ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা : ডুরখেইম এর মতে , “ সমাজবিজ্ঞান হলো অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান । ”

ডেভিড ড্রেসলার তাঁর ‘ Sociology ‘ গ্রন্থে বলেছেন , “ সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন । ”

আধুনিক সংজ্ঞা : বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার তাঁর ‘ Society ‘ গ্রন্থে বলেছেন , “ সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান , যা সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পাঠ করে । ”

ম্যাক্সওয়েবার এর মতে , “ সমাজবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো সামাজিক কার্যাবলির অধ্যয়ন এবং সামাজিক কার্যাবলির মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যাখ্যাদান করা । ”

সর্বাধুনিক সংজ্ঞা : ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিল জে , স্পেনসার তাঁর ‘ Sociology ‘ গ্রন্থে বলেছেন , “ সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে এমন একটি অভিজ্ঞতা বা গবেষণানির্ভর বিজ্ঞান যা সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে অধ্যয়ন করে । ”

 

সমাজবিজ্ঞানের জনক কে?

অগাস্ট কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি একজন ফরাসী দার্শনিক ছিলেন। তাকে সমাজ বিজ্ঞানের পিতা বলা হয়। ১৮৩৮ সালে সর্বপ্রথম তিনি সমাজবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে ইবনে খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানের আদি বা প্রাচীন জনক মনে করা হয়।

অগাস্ট কোৎ এর সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা

অনেক সমাজতাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞানের প্রামাণ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তবে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত সংজ্ঞাটি প্রদান করেছেন সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোৎ, তিনি বলেন, “Sociology is the scientific study of the society” অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় অধ্যায়নের বিজ্ঞান। অগাস্ট কোৎ সমাজবিজ্ঞান শাস্ত্রে বিশেষ অবদান রাখেন, যার জন্য অগাস্ট কোৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনিই Sociology (বাংলা অর্থ হচ্ছে সমাজবিজ্ঞান) শব্দটি প্রবর্তন করে সমাজবিজ্ঞানকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেন।

Comte (অগাস্ট কোৎ), scientific study শব্দদ্বয় দ্বারা আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন  তা একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক। scientific study (বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা) দ্বারা scientific method of study বা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পর্যালোচনা  কে বুঝানো হয়েছে । আর বিজ্ঞান যে প্রক্রিয়ার বস্তুজগতের ব্যাখ্যা প্রদান করে সেইটাকে বলা হয় Doctrine of causality (ঠিক একই মেথড থমাস হবসও তার political philosophy এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন) অর্থাৎ প্রত্যেকটা incidence বা ঘটনা প্রবাহের পিছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। আর এই সুনির্দিষ্ট কারণগুলো অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজ্ঞান material world বা বস্তুজগতকে বিশ্লেষণ করে। তেমনি সমাজবিজ্ঞান সামাজিক ঘটনাপ্রবাহকে এই একই প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করে বলে সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোৎ সমাজবিজ্ঞানকে social physics বা সমাজের পদার্থবিদ্যা বলেছেন। এবার Doctrine of Causality এর একটা বাস্তবধর্মী এক্সাম্পল দেয়া যাক।

আমরা জানি যে আগুনের সংস্পর্শে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, এখানে ছাই হয় effect বা ঘটনা এইটার cause বা কারণ হচ্ছে আগুন। আবার, ধর্ম যদি হয় ইফেক্ট বা ফলাফল, এর cause বা কারণ হচ্ছে geography বা ভূগোল, কারণ কোন অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ওই অঞ্চলের ধর্মের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।

সমাজবিজ্ঞান এর সাথে বিজ্ঞান এর সম্পর্ক

সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজের বিজ্ঞান, অগাস্ট কোৎ সমাজবিজ্ঞানকে বলেছেন, social physics বা সমাজের পদার্থবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, যেমন-

  • সমাজবিজ্ঞান কেন বিজ্ঞান?
  • সমাজবিজ্ঞান কি ধরনের বৈজ্ঞানিক কার্য সাধন করে?
  • সমাজবিজ্ঞান কেন এবং কিভাবে বিজ্ঞান?

এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বিজ্ঞান যেমন এবং যেই প্রক্রিয়ায় বস্তুজগতের ধর্ম (law of material world) উদঘাটন করে, সমাজ বিজ্ঞান একই প্রক্রিয়ায় মানুষের সমাজ জীবনের ধর্ম উদঘাটন করে থাকে। বিজ্ঞান যেমন matter বা বস্তুকে প্রয়োগিক ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বস্তুর ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে এবং বস্তুসমূহের মধ্যাকার সম্পর্কের স্বরুপ ও ফলাফল ব্যাখ্য করে, ঠিক তেমনিভাবে সমাজবিজ্ঞান প্রয়োগিক এবং বাস্তবিকভাবে পর্যবেক্ষন ও নিরিক্ষনের দ্বারা সমাজ জীবনের ধর্ম নিরুপন করে। একইসাথে সমাজবিজ্ঞান Social mechanism বা সমাজের সমাজ হিসেবে এগিয়ে চলার বিষয়টিও ব্যাখ্যা করে থাকে। সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক ও সামাজিক সমস্যার কারণ এবং প্রতিকারও প্রদান করে থাকে সামাজকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় অধ্যায়নের মাধ্যমে। যুক্তি ও বাস্তবিকতার মানদন্ড উত্তির্ণ না হলে বিজ্ঞান যেমন সেটাকে স্বীকার করে না, সমাজবিজ্ঞানও যুক্তি ও বাস্তবিকতা বিবর্জিত কোনকিছুকেই স্বীকৃতি প্রদান করে না। সমাজবিজ্ঞানের মূল প্রত্যয়গুলোর মধ্যে rationality বা যুক্তিসিদ্ধতা, causality বা কার্যকরণ-সম্পর্ক অন্যতম।

যেহেতু সমাজবিজ্ঞান বিজ্ঞানের মতই বাস্তব নিরীক্ষণ ও যুক্তিনির্ভর একটি জ্ঞান, সে কারণেই সমাজবিজ্ঞানও এক প্রকার বিজ্ঞান যা বৃহত্তর পরিসরে সমাজ-জীবনের নানা দিককে যৌক্তিক ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে এবং সামাজিক সমস্যাবলির কারণ নির্ণয় ও সেই মোতাবেক প্রতিকার প্রদান করে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে , সমাজবিজ্ঞান হলো জ্ঞানের সে শাখা বা শাস্ত্র যার আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাজের গঠনপ্রণালী , পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামো , সমাজস্থ মানুষের আচার আচরণ কার্যাবলি তথা সমাজের স্বরূপ প্রতিফলিত হয় ।

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “সমাজ বিজ্ঞান কাকে বলে? সমাজবিজ্ঞানের জনক কে?” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।