ড্রপশিপিং কি? ড্রপশিপিং ব্যবসা থেকে আয় করে কিভাবে? What Is Dropshipping?

ড্রপশিপিং (Dropshipping) করে আয় করার বিষয়টি কমবেশি সবার শোনার কথা। কিন্তু এই সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার ফলে ইচ্ছুক হওয়া স্বত্বেও অনেকে ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। চলুন জেনে নেওয়া যাক ড্রপশিপিং কি, ড্রপশিপিং এর সুবিধা-অসুবিধা, কিভাবে ড্রপশিপিং ব্যবসা করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত।

ড্রপশিপিং কি? (What Is Dropshipping?)
ড্রপশিপিং এর ধারণাটি বোঝা বেশ সহজ। ড্রপশিপিং ব্যবসা যিনি করেন তিনি সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকে প্রোডাক্ট নিয়ে সরাসরি কাস্টমারের কাছে পৌছেঁ দেন। এটি মূলত একটি খুচরা ব্যবসা, যার থেকে ড্রপশিপিং যিনি করেন তিনি ভালো অংকের লাভ করতে পারেন।

আরো সহজ করে বুঝি চলুন। ধরুন আপনি কোনো একটি প্রোডাক্ট নিয়ে ড্রপশিপিং ব্যবসা করেন। এক্ষেত্রে উক্ত প্রোডাক্ট আপনাকে সরাসরি সরবরাহ বা জমা করতে হবেনা। বরং আপনি কাস্টমারের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর প্রোডাক্ট সরবরাহকারী (সাপ্লাইয়ার) থেকে প্রোডাক্ট সরাসরি কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দিবেন। যিনি সেলার অর্থাৎ ড্রপশিপিং করছেন, তাকে কখনো সরাসরি কোনো প্রোডাক্টের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হয়না।

যিনি ড্রপশিপিং ব্যবসা করছেন, তিনি হলেন সেলার। যিনি অর্ডার করছেন তিনি কাস্টমার। অন্যদিকে যে প্রোডাক্ট সরবরাহ করছেন তিনি সাপ্লাইয়ার।
তবে কাজ কিছুটা সহজ হলেও প্রতি সেল এর ক্ষেত্রে লাভ করেন সেলার। কারণ সাপ্লাইয়ার থেকে যে দামে প্রোডাক্ট কেনা হোক না কেনো, কাস্টমারের কাছে তার চেয়ে বেশি দামে প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারেন একজন সেলার।

ড্রপশিপিং এর সুবিধা (What is the advantage of using Dropshipping?)
ড্রপশিপিং এর বেশ কিছু সুবিধা বিদ্যমান। ব্যবসাসমূহ তাদের সময় ও অর্থ বাচাঁতে ড্রপশিপিং এর ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে জমা থাকা পণ্য খালি করতে ব্যবহার হয় ড্রপশিপিং এর।

প্রোডাক্ট স্টোর করতে হয়না

ড্রপশিপিং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো একজন সেলারের কোনো প্রোডাক্ট স্টোর করতে হয়না। অর্থাৎ প্রোডাক্ট সেল করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আগে থেকে জমা রাখতে হয়না। এর মাধ্যমে একাধিক সুবিধা পাওয়া যায়। প্রথমত জমা রাখার ফলে ঘটিত সম্ভাব্য ক্ষতিসমুহ এড়ানো যায়। আবার প্রোডাক্ট জমা রাখতে যে অর্থ খরচ হতে পারতো, তা মার্কেটিং বা অন্য কাজে লাগানো যায়।

শিপিং করতে হয়না
ড্রপশিপিং এর ক্ষেত্রে প্রোডাক্ট শিপিং করা নিয়ে ভাবতে হয়না একজন সেলারকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ফি নেয় সাপ্লাইয়ার যার বিনিময়ে শিপিং তারা সম্পন্ন করে। নিজে শিপিং করা থেকে এই শিপিং ফি এর মাধ্যমে শিপিং করানো অধিক সাশ্রয়ী।

ক্ষতির সম্ভাবনা কম
যেহেতু ড্রপশিপিং ব্যবসায় কোনো আইটেম অর্ডার করে জমা রাখতে হয়না, তাই অতিরিক্ত বা কম আইটেম থাকার ফলে সাধিত ক্ষতির সম্ভাবনা কম। যেহেতু কাস্টমারের যথাযথ ডিমান্ড অনুযায়ী প্রোডাক্ট সাপ্লাই করা হয়, তাই ড্রপশিপিংয়ে প্রোডাক্ট সংক্রান্ত ক্ষতির সম্ভাবনা কম। এছাড়া আপনি সব সময়ই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।

ঝুঁকি কম
ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করতে লাখ লাখ টাকা ইনভেস্ট করার প্রয়োজন হয়না। প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ারের কাছে থাকে, আর সেলার শুধুমাত্র কাস্টমারের অর্ডার পেলেই প্রোডাক্ট সরবরাহের কাজ করেন। অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতির বড় কোনো ঝুঁকি নেই।

ড্রপশিপিং এর অসুবিধা (What is the disadvantage of using Dropshipping?)
সেলার বা কাস্টমার উভয়ের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ড্রপশিপিং বেশ সুবিধা বয়ে আনে। তবে ড্রপশিপিং ব্যবসার কিছু নেতিবাচক দিক ও রয়েছে।
প্রথমত প্রোডাক্ট শিপিং এর সম্পূর্ণ কাজ যেহেতু সাপ্লাইয়ার করে, তাই একজন সেলারের এই ব্যাপারে কোনো ভূমিকা থাকেনা। তাই সাপ্লাইয়ার প্রোডাক্ট ডেলিভারিতে দেরি করলে তার দায়ভার সেলারের উপর বর্তায়।

বিক্রিত পণ্য কিন্তু একজন সেলারের নিজে পরখ করে দেখার সুযোগ থাকেনা। তাই প্রোডাক্টের কোয়ালিটি সম্পর্কে একজন সেলারের জানা থাকা প্রায় অসম্ভব। এমনকি অজান্তে লো-কোয়ালিটি আইটেম সেল করার মাধ্যমে বিশাল সমস্যায় পড়তে পারেন একজন সেলার।
আবার একজন সাপ্লাইয়ারের কোনো প্রোডাক্টের স্টক শেষ হয়ে গেলে সেক্ষেত্রেও একজন সেলার সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।

ড্রপশিপিং ব্যবসায় যেহেতু প্রতিটি প্রোডাক্ট আলাভাবে কেনা হয়, তাই খুচরা দামে প্রোডাক্ট কেনায় প্রোডাক্টের দাম বেশি থাকে। যেখানে হয়ত পাইকারি দামে একই প্রোডাক্ট এর চেয়ে কম দামে পাওয়া যাবে। এই কারণে লাভের সুযোগ থাকলেও ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হয়না।
ড্রপশিপিং এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গুণগত মানের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, যার ফলে কাস্টমার অসন্তোষ এর মত ঘটনা ঘটতে পারে। তাই বিশ্বাস করা যায়, শুধুমাত্র এমন সাপ্লাইয়ার থেকে প্রোডাক্ট নেওয়া উচিত।

ড্রপশিপিং কিভাবে কাজ করে? (How does dropshipping work?)
ড্রপশিপিং ব্যবসা কিভাবে করবেন, তা জানার আগে ড্রপশিপিং ব্যবসা আসলে কীভাবে কাজ করে তা জানা একান্ত জরুরি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে প্রোডাক্ট গুদামজাত না করে সরাসরি প্রক্রিয়াজাতকারী বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসাকে বলা হচ্ছে ড্রপশিপিং।

ধরুন আপনি ড্রপশিপিং ব্যবসা করতে চান। এবার চলুন ধাপে ধাপে বুঝি কিভাবে ড্রপশিপিং ব্যবসা করতে পারবেনঃ

  • সাপ্লাইয়ার খুঁজে বের করুন
  • যেসব প্রোডাক্ট সেল করতে চান, তা নির্বাচন করুন
  • খুচরা দামের ব্যানারে উক্ত পণ্যসমূহ অনলাইনে প্রদর্শন করুন
  • আপনি চাইলে আপনার ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেজ এ পণ্য প্রদর্শন করতে পারেন
  • আপনার ড্রপশিপিং ব্যবসার প্রচার করুন
  • এরপর কাস্টমারের কাছ থেকে অর্ডার পাবেন
  • সাপ্লাইয়ারকে কাস্টমারের অর্ডার সম্পর্কে অবগত করুন
  • অর্ডার শিপিং প্রক্রিয়া শুরু করতে সাপ্লাইয়ারকে নির্দেশনা প্রদান করুন
  • কাস্টমার প্রোডাক্ট হাতে পেয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করুন
  • কাস্টমারের কোনো ধরনের জিজ্ঞাসা বা সমস্যা থাকলে তা বিবেচনা করুন।
ড্রপশিপিং ব্যবসা কি বৈধ?
হ্যাঁ, ড্রপশিপিং ব্যবসা পদ্ধতি লিগ্যাল বা বৈধ। তবে বাড়তি সতর্কতা দরকার কিছু বিষয়ে, যেমনঃ সাবধানতার সহিত শিপিং সম্পন্ন করা, বৈধ পণ্য বিক্রি করা, স্থানীয় আইন মেনে চলা ইত্যাদি। সাপ্লাইয়ার যদি অবৈধ কোনো পণ্য সরবরাহ করে, সেক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন সেলার। তাই একজন সেলারের উচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর নিয়ম-নীতি মেনে চলা।
আন্তর্জাতিক অর্ডার কি ড্রপশিপিং করা যাবে?
বর্তমানে অধিকাংশ শিপিং সেবাদাতাকারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিপিং করে থাকে। আবার বেশিরভাগ দেশের আন্তর্জাতিক পণ্য ইমপোর্ট এর ব্যাপার দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে কাস্টমস এজেন্সি। অর্থাৎ যে দেশে শিপিং করা হবে, সে দেশের নিয়মনীতি অনুসরণ করে কোনো সমস্যা ছাড়াই আন্তর্জাতিক অর্ডার শিপিং করা যাবে।
ড্রপশিপিং করে আয় করার নিয়ম
ড্রপশিপিং ব্যবসা কিভাবে কাজ করে সে তথ্য তো জানা গেলো। এবার ধাপে ধাপে জানি চলুন কিভাবে ড্রপশিপিং করে আয় করবেন।
ড্রপশিপিং ব্যবসার বিষয় নির্বাচন
ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে প্রথমে কি ধরনের প্রোডাক্ট নিয়ে ব্যবসা করবেন তা নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার পছন্দ ও লাভ হবে এমন ক্যাটাগরি নির্বাচন করুন।
যেসব বিষয়ে ড্রপশিপিং করে ভালো লাভ করা যায়, সেগুলোই মূলত ভালো ড্রপশিপিং ব্যবসার বিষয়। কি বিষয়ে ড্রপশিপিং ব্যবসা শুরু করবেন, তা খুঁজে বের করতে পারেন নিম্নোক্ত উপায়েঃ
  • গুগল ট্রেন্ড এর মাধ্যমে বর্তমানে কি ধরনের প্রোডাক্ট সম্পর্কে মানুষের বেশি কৌতূহল তা জানতে পারবেন
  • উবারসাজেস্ট এর মত কিওয়ার্ড টুল ব্যবহার করে যেকোনো বিষয়ে করা সার্চের এনালাইসিস পাবেন
  • আপনার পছন্দের বিষয় সম্পর্কে তৈরী ওয়েবসাইটসমূহ ঘুরে দেখতে পারেন
  • বিভিন্ন প্রোডাক্টের অনলাইনে কেমন ডিমান্ড, তা বিবেচনা করুন।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে জানুন
যেকোনো ব্যবসা করতে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ব্যবসা শুরুর আগে অবশ্যই আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থা সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরি। একাধিক উপায়ে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে জানতে পারেন। যেমনঃ
  • গুগল সার্চ করে কোনো নির্দিষ্ট প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে যেসব ওয়েবসাইট র‍্যাংক করছে তার থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারণা পাবেন
  • এলেক্সা বা সিমিলারওয়েব এর মত ওয়েবসাইট ব্যবহার করে বেশ সহজেই এক প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বি ও তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন
  • সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থান বিশ্লেষণ করুন
  • আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেক্ষেত্রে ভালো করছে, সেসব নিয়ম অনুসরণ করে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
সাপ্লাইয়ার খুঁজে বের করা
এবার পালা আসল ব্যবসা শুরু করার।  প্রথমে একাধিক সাপ্লাইয়ার খুঁজে বের করুন। তাদের প্রত্যেক্যের কাছ থেকে স্যাম্পল অর্ডার করুন। এরপর শিপিং এর সময়, কোয়ালিটি, ইত্যাদি বিবেচনা করে সেরা সাপ্লাইয়ার নির্বাচন করুন।
ড্রপশিপিং বিজনেস স্টোর তৈরি
ড্রপশিপিং ব্যবসার ক্ষেত্রে দরকার পড়বে একটি বিজনেস স্টোরের, যেখান থেকে কাস্টমাররা প্রোডাক্ট অর্ডার করতে পারবে। হোস্টিং ও ডোমেইন নেম কিনে তৈরি করে ফেলুন আপনার বিজনেস স্টোর। আপনি চাইলে আলিড্রপশিপ ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিনের মাধ্যমে দারুণ একটি ড্রপশিপিং সাইট বানাতে পারেন। মূলত এখান থেকেই আপনার ব্যবসার মূল কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। কাস্টমার আপনার ওয়েবসাইটে এসে অর্ডার দিবে।
ড্রপশিপিং ব্যবসা মার্কেটিং
ড্রপশিপিং ব্যবসা কিন্তু ওয়েবসাইট বানিয়ে প্রোডাক্ট প্রদর্শন করেই শেষ নয়। কাস্টমার পেতে হলে কাস্টমারকে আপনার ব্যবসার কথা জানাতে হবে। এজন্য দরকার হবে ব্যবসাকে সম্ভাব্য ক্রেতাদের নিকট পরিচিত করা।
একাধিক উপায়ে ড্রপশিপিং ব্যবসার প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা যায়। যেমনঃ
  • এসইওঃ আপনার ওয়েবসাইট ও তার কনটেন্ট সার্চ ইঞ্জিনের জন্য অপটিমাইজ করার মাধ্যমে যেকেউ প্রোডাক্ট সার্চ করলে আপনার ব্যবসা সম্পর্কে জানতে পারবে
  • ফেসবুক বিজ্ঞাপনঃ ফেসবুক অ্যাড এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে অসংখ্য নতুন কাস্টমারের কাছে পৌঁছানো যায়
  • ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংঃ বেশিরভাগ মানুষ তাদের পছন্দের ইনফ্লুয়েন্সারকে ফলো করে চলতে পছন্দ করেন বলে ইনফ্লুয়েন্সার এর দ্বারা ড্রপশিপিং ব্যবসার প্রসার ঘটানো যায়
কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট
অর্ডার পাওয়ার পর প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ার এর মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে পৌছেঁ দিলে একজন সেলার এর কাজ শেষ হয়ে যায়না। কাস্টমার প্রোডাক্ট ঠিকমত বুঝে পেয়েছে কিনা, কোনো অভিযোগ আছে কিনা – দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসাতে এসব বিষয় সম্পর্কে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত জরুরি। তাই সেলারের উচিত তার কাস্টমারের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেওয়া। এই ফিডব্যাক কাজে লাগিয়ে কাস্টমার ধরে রাখার পাশাপাশি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ব্যবসার প্রচার ও প্রসার ঘটে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *