যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম কি? এর গঠন, শর্তাবলী এবং সুবিধা। (Linear programming in Bangla)

যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম কি? (What is linear programming with example in Bengali/Bangla?)
যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামিং একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশল, যার মাধ্যমে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনশীল কারখানাগুলিতে সৃজনশীল পরিকল্পনা দ্বারা কম বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব। সুতরাং যেকোনো উৎপাদন কারখানাকে লাভজনক করতে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম (Linear programming)
যোগাশ্রয়ী শব্দের অর্থ রৈখিক (Linear) এবং প্রোগ্রাম শব্দের অর্থ পরিকল্পনা, যাদ্বারা কোনো কর্ম সম্পাদনের বিভিন্ন উপায়ের মধ্য হতে সবচেয়ে ভালো উপায় নির্ধারণ করা বুঝায়। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা করি। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং উৎপাদন কারখানাগুলিতেও সুপরিকল্পনা দ্বারা সর্বনিম্ন বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কোনো উৎপাদন কারখানায় পুজি, শ্রম, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির কোনটির কি পরিমাণে সমাবেশ ঘটালে সীমিত ব্যয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে তা নিরূপণ করা যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য। ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে রাশিয়ার গণিতবিদ এল, ভি, ক্যান্ট্রভিচ (KANTOROVICH) সর্ব প্রথম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্যাকে গাণিতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামের একটি মডেল তৈরি করেন।

কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্যাকে তার সীমাবদ্ধতা ও শর্ত সাপেক্ষ একাধিক স্বাধীন চলকের রৈখিক অসমতা ও একটি অভিষ্ট ফাংশন (Z = ax + by) গঠনই হল যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম।

সংজ্ঞাঃ যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামিং হলো এমন একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশল যার সাহায্যে যেকোনো উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর নিজস্ব সৃজনশীল পরিকল্পনা দ্বারা সমস্যাগুলি গাণিতিকভাবে দুই বা ততোধিক স্বাধীন চলকের (Linear) সম্বলিত একসেট অসমতায় প্রকাশের মাধ্যমে অভিষ্ট ফাংশনের কাঙ্ক্ষিত মান নির্নয় করা যায়।

যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম স্বল্পব্যয়ে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ, আকৃতি ও গুণগত মান নির্ধারণ করে। যেকোনো উৎপাদন কারখানাকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য যার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং আধুনিক উৎপাদন ও বিপণন ক্ষেত্রে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামই একমাত্র উৎকৃষ্ট হাতিয়ার।

যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠন (Structure of linear programming)
নিচের ধাপগুলি অনুসরণ করে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠন করা হয়।
প্রথম ধাপঃ সিদ্ধান্তকারীকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সমস্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত চলকগুলি চিহ্নিত করে সমস্যাটিকে চলকের মাধ্যমে প্রকাশ করা। যেমন, দ্রব্যের কোনটি কি পরিমাণ উৎপাদন করলে সর্বোচ্চ মুনাফা হবে তা x, y চলক দ্বারা প্রকাশ করা।
দ্বিতীয় ধাপঃ যার পরিমাণ সর্বোচ্চ অথবা সর্বনিম্ন করতে হবে তাকে উপরোক্ত চলক দ্বারা গাণিতিক ফাংশনে প্রকাশ করা, যাকে অভীষ্ট ফাংশন (Objective Function) বলে।
তৃতীয় ধাপঃ সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতাগুলি চিহ্নিত করে তাদেরকে চলকের মাধ্যমে রৈখিক সমীকরণ বা অসমতা আকারে প্রকাশ করা। এগুলিকে সীমাবদ্ধতার (constraints) সেট বলে।
চতুর্থ ধাপঃ রৈখিক সমীকরণগুলির লেখ অঙ্কন করে এদের সমাধান এলাকা বা অনুকূল এলাকা (Feasibility Regions) চিহ্নিত করা।
পঞ্চম ধাপঃ চিহ্নিত ক্ষেত্রের কৌণিক বিন্দুগুলির স্থানাঙ্ক অভীষ্ট ফাংশনে বসিয়ে এর সর্বোচ্চ অথবা সর্বনিম্ন মান নির্নয় করা।

নিচের উদাহরণ এর সাহায্যে বাস্তব জীবন ভিত্তিক সমস্যার যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠন ব্যাখা করা হলো।

উদাহরণঃ একজন কৃষক ধান এবং গমের চাষ করতে গিয়ে দেখলেন যে, প্রতি হেক্টর জমিতে ধান ও গম চাষের খরচ যথাক্রমে 1200 টাকা এবং 800 টাকা। প্রতি হেক্টর জমিতে ধান ও গম চাষের জন্য যথাক্রমে 4 জন ও 6 জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। সর্বোচ্চ 26 জন শ্রমিক নিয়োগ করে এবং 4800 টাকা বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ কত হেক্টর জমি তিনি চাষ করতে পারবেন।

সমস্যাটির একটি যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠন করতে হবে।

সমাধানঃ
যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠনঃ
সমস্যাটিকে যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম গঠন করার জন্য নিচের ধাপগুলো প্রয়োগ করতে হবে।

প্রথম ধাপঃ মনে করি, কৃষক সর্বোচ্চ x হেক্টর জমিতে ধান এবং y হেক্টর জমিতে গমের চাষ করতে পারবেন।

দ্বিতীয় ধাপঃ যার মান সর্বোচ্চ করতে হবে অর্থাৎ অভীষ্ট ফাংশন Z (সর্বোচ্চ) = x + y.

তৃতীয় ধাপঃ প্রতি হেক্টর জমিতে ধান ও গম চাষের খরচ যথাক্রমে 1200 টাকা এবং 800 টাকা।
সুতরাং x হেক্টর ধান চাষে খরচ 1200x এবং y হেক্টর গম চাষে খরচ 800y টাকা। বিনিয়োগকৃত টাকা সর্বোচ্চ ৪৮০০.
সুতরাং,  1200x + 800y ≤ 4800 …….. (1)

আবার x হেক্টর ধান চাষে শ্রমিক লাগে 4x জন এবং y হেক্টর গম চাষে শ্রমিক লাগে 6y জন। দেওয়া আছে, শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ 26 জন। তাহলে,  4x + 6y ≤ 26 ………. (2)
জমির পরিমাণ x > 0, y > 0 ………….(3)

চতুর্থ ধাপঃ গঠিত অসমতা (1), (2) ও (3) এর সংশ্লিষ্ট সমীকরণের লেখচিত্র অঙ্কনের সাহায্যে সমাধান এলাকার কৌণিক বিন্দুগুলির স্থানাঙ্ক অভীষ্ট ফাংশন Z = x + y তে বসিয়ে কাঙ্খিত মান পাওয়া যায়।

যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম এর শর্তাবলী (Principle of linear programming)
কতকগুলি শর্তপূরণ সাপেক্ষে যেকোনো সমস্যার (সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন মান নির্নয় করুন)  সমাধান করার জন্য যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রাম প্রয়োগ করা হয়। নিচে শর্তগুলি উল্লেখ করা হলঃ
(i) সমস্যার একটি অভীষ্ট ফাংশন (যেমন মুনাফা বা উৎপাদন ব্যয়) অবশ্যই থাকতে হবে যার সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন মান নির্ণয় করতে হবে এবং তাকে সিদ্ধান্ত চলকের রৈখিক ফাংশন হিসেবে প্রকাশ করা যাবে।
(ii) সমস্যার অবশ্যই বিকল্প পদ্ধতির কার্যক্রম এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেমন, একটি দ্রব্য দুইটি মেশিনে প্রস্তুত হতে পারে। এরূপক্ষেত্রে সমস্যা হবে কোন মেশিনে কত একক দ্রব্য প্রস্তুত হবে তা নির্ণয় করা।
(iii) সমস্যার জন্য অবশ্যই সীমিত সম্পদ থাকতে হবে। যেমন, একটি উৎপাদন কারখানায় কাঁচা মালের যােগান সীমিত হতে বাধ্য।
(iv) প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত সীমাবদ্ধতা ও শর্তগুলি একাধিক রৈখিক অসমতায় প্রকাশযােগ্য হবে।
(v) সিদ্ধান্ত চলকগুলি অবশ্যই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও অঋণাত্মক হতে হবে। যেমন, দুই প্রকার দ্রব্যের একটি x একক এবং অন্যটি y একক প্রস্তুত করা হলে x ও y অঋণাত্মক হবে, অর্থাৎ x ≥ 0, y ≥ 0.

যােগাশ্রয়ী প্রােগ্রাম এর সুবিধা (Advantages of linear programming)
যােগাশ্রয়ী প্রােগ্রামের উদ্দেশ্য সর্বনিম্ন বিনিয়ােগ ও সর্বোচ্চ লাভ। এর সুবিধাগুলি নিম্নরূপঃ
(i) উৎপাদন যােগ্য চলকের কাঙ্খিত মান নির্ধারণে সহায়ক। যেমন, প্রাতিষ্ঠানিক লােকবল, যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামালের ন্যূনতম ব্যবহার করে লক্ষ্যমাত্রার পণ্য উৎপাদন সম্ভব।
(ii) ভবিষ্যত কালের ব্যবস্থাপকের উৎপাদনের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
(iii) সকল প্রতিবন্ধকের সাথে পরিচিত হওয়া সম্ভব হয় এবং কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও বিতরণের স্বল্প ব্যয় নিশ্চিত করা যায়।
(iv) অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা ও শর্ত হ্রাস পায়, যার ফলে সিদ্ধান্তের মাত্রা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়।
(v) বৃহৎ শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের আকৃতি ও গুণগত মান নির্ধারণে এবং সামরিক কার্যক্রমে যােগাশ্রয়ী প্রােগ্রামের ভূমিকা অপরিসীম।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *