টিস্যুকালচার কি? টিস্যুকালচার এর ব্যবহার ও প্রয়োগ – What is Tissue culture?

সাধারণত এক বা একাধিক ধরনের এক গুচ্ছ কোষসমষ্টিকে টিস্যু (Tissue) বা কলা বলা হয়। একটি টিস্যুকে জীবাণুমুক্ত পুষ্টিবর্ধক কোনাে মিডিয়ামে (Nutrient medium) বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়াই হলাে টিস্যু কালচার। টিস্যু কালচার উদ্ভিদবিজ্ঞানের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা।
উদ্ভিদ টিস্যু কালচারে উদ্ভিদের কোনাে বিচ্ছিন্ন অংশ বা অঙ্গবিশেষ (যেমন পরাগরেণু, শীর্ষ বা পার্শ্বমুকুল, পর্ব, মূলাংশ ইত্যাদি) কোনাে নির্দিষ্ট পুষ্টিবর্ধক মিডিয়ামে জীবাণুমুক্ত অবস্থায় কালচার করা হয়। মিডিয়ামগুলােতে পুষ্টি এবং বর্ধনের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল উপাদান সরবরাহ করা হয়। টিস্যু কালচারের উদ্দেশ্যে উদ্ভিদের যে অংশ পৃথক করে নিয়ে ব্যবহার করা হয় তাকে ‘এক্সপ্ল্যান্ট’ (Explant) বলে।

টিস্যু কালচারের ব্যবহার

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আজকাল উদ্ভিদ প্রজননের ক্ষেত্রে এবং উন্নত জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গেছে এবং এ ক্ষেত্রগুলােতে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্ভিদ অংশ থেকে কম সময়ের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসংখ্য চারা সৃষ্টি করা যায়। সহজেই রােগমুক্ত, বিশেষ করে ভাইরাসমুক্ত চারা উৎপাদন করা যায়। ঋতুভিত্তিক চারা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। স্বল্পসময়ে কম জায়গার মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক চারা উৎপাদনের সুবিধা থাকায় চারা মজুদের সমস্যা এড়ানাে যায়।
যে সব উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে না, সেগুলাের চারাপ্রাপ্তি এবং স্বল্পব্যয়ে দ্রুত সতেজ অবস্থায় স্থানান্তর করা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন এবং সংরক্ষণ করতে টিস্যু কালচার নির্ভরযােগ্য প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। যেসব ভ্রূণে শস্যকলা থাকে না, সেসব ভ্রূণ কালচার করে সরাসরি উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়। যে সকল উদ্ভিদে যৌনজনন অনুপস্থিত অথবা প্রাকৃতিকভাবে জননের হার কম, তাদের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যায়। নতুন প্রকৃতির উদ্ভিদ উদ্ভাবনে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফরাসি বিজ্ঞানী George Morel (1964) প্রমাণ করে দেখান যে সিম্বিডিয়াম (Cymbidium) নামক অর্কিড প্রজাতির একটি মেরিস্টেম থেকে এক বছরে প্রায় 40 হাজার চারা পাওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য, সাধারণ নিয়মে একটি সিম্বিডিয়াম উদ্ভিদ থেকে বছরে মাত্র অল্প কয়েকটি চারা উৎপন্ন হয়। থাইল্যান্ড টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে এক বছরে 50 মিলিয়ন অণুচারা উৎপন্ন করে, যার অধিকাংশই অর্কিড। এই ফুল রপ্তানি করে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। 1952 সালে মার্টিন নামক বিজ্ঞানী মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে রােগমুক্ত ডালিয়া ও আলুগাছ উদ্ভব করেন। বর্তমানে মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে কোনাে কোনাে ভাইরাস রােগাক্রান্ত ফুল ও ফলগাছকে (যেমন আলুর টিউবার) রােগমুক্ত করা টিস্যু কালচারের একটি নিয়মিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় oil Palm-এর বংশবৃদ্ধি টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হয়।
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চন্দ্রমল্লিকার একটি অঙ্গজ টুকরা থেকে বছরে ৪৪ কোটি চারা গাছ পাওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে জুই (Jasminum) সাস্পেনসান থেকে সুগন্ধি আতর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। উড়ােজাহাজ, রকেট প্রভৃতি ভারী ইঞ্জিন চলানাের জন্য এক রকমের তিমি মাছের (Sperm whale) তেলের প্রয়ােজন হয়। এই তিমি মাছ ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র জোজোবা (jojoba) নামক গাছ হতে নিষ্কাশিত তেল বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু এই গাছ এক বিশেষ মরুভূমির পরিবেশ ছাড়া (যেমন Arizona, California) জন্মায় না এবং এদের বংশবৃদ্ধিও অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ।
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে এই গাছের দ্রুত বংশবৃদ্ধি করাই কেবল সম্ভব হয়নি, একে ভারতবর্ষের জলবায়ু উপযােগীও করে তােলা হয়েছে। বাংলাদেশে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে ইতােমধ্যে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যেমন, বিভিন্ন প্রকার দেশি ও বিদেশি অর্কিডের চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। রােগ প্রতিরােধী এবং অধিক উৎপাদনশীল কলার চারা, বেলের চারা, কাঁঠালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, লিলি, কার্নেশান প্রভৃতি ফুল উৎপাদনকারী বৃক্ষের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। বিভিন্ন ডালজাতীয় শস্য, বাদাম ও পাটের চারার উৎপাদন করা হয়েছে। টিস্যু কালচার প্রয়ােগ করে আলুর রােগমুক্ত চারা এবং বীজ মাইক্রোটিউবার উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

কৃষিক্ষেত্রে টিস্যুকালচারের ভূমিকা
টিস্যুকালচার বায়োটেকনোলজির একটি শাখা। বায়োটেকনোলজির এ শাখাটি কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন– উদ্ভিদের অংশ থেকে অল্প সময়ে একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসংখ্য চারা এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা যায়। কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের চারা টিস্যুকালচারের মাধ্যমে সারা বছর উৎপাদন করা সম্ভব। অল্প সময়ে কম জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক চারা উৎপাদন সম্ভব।

যেসব উদ্ভিদের বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয় না, টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তাদের চারা তৈরি সম্ভব। এ পদ্ধতির মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন ও সংরক্ষণ সম্ভব। সহজেই রোগমুক্ত চারা, বিশেষ করে ভাইরাসমুক্ত চারা টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তৈরি করা যায়।
উপরের ছোট আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, টিস্যুকালচারের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রের অনেক সমস্যার সমাধান তথা কৃষকের চাহিদামত রোগমুক্ত চারা সরবরাহ করা সম্ভব। এক কথায় কৃষিক্ষেত্রে টিস্যুকালচারের গুরুত্ব অপরিসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *