শাসক হিসেবে বাবরের অবদান মূল্যায়ন কর
শাসক হিসেবে সম্রাট বাবরের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
১৫২৬ সালে সংঘটিত পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষ হতে ৩০০ বছরেরও বেশি সময় শাসনকারী সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে।
এ যুদ্ধে জয়লাভের মধ্যে দিয়ে বাবর ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসনের সূচনা করেন। বাবর ছিলেন বিজেতা শাসক।
তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতৃ সিংহাসনে আরোহণ করে বিভিন্ন রাজ্য জয় করে যে কৃতিত্বের পরিচয় দেন তা ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শাসক হিসেবে বাবর বিভিন্ন গুণের অধিকারী ছিলেন।
→ শাসক হিসেবে সম্রাট বাবরের কৃতিত্ব : শাসনক্ষেত্রে বাবর অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। শাসক হিসেবে সম্রাট বাবরের কৃতিত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন : পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর লোদী শাসক ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতবর্ষ হতে প্রায় ৩০০ বছরেরও অধিক সময় শাসনকারী সালতানাতের পতন ঘটে।
২. গোলন্দাজ বাহিনী গঠন : পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করে বাবর দিল্লি ও আগ্রা জয় করে নেন। এর পর তিনি তার বিজিত অঞ্চল সুরক্ষিত করার জন্য সামরিক বাহিনীর অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করেন।
৩. উদ্যমী শাসক : সম্রাট বাবর ছিলেন উদ্যমী শাসক। সম্রাট বাবর তার অভিষেক রাজ্য থেকে পরপর দুইবার রাজ্যচ্যুত হন। এতে তিনি মোটেও হতাশ হননি। দুবার তিনি যুদ্ধ করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
তিনি ছিলেন রবার্ট ব্রুসের মতো এবং লেনিনের মতো অধ্যবসায় এবং ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। তাছাড়া তিনি দৈহিক গড়নেও ছিলেন শক্তিশালী ও | সবল একজন বীর যোদ্ধা ।
৪. নিরলস কর্মী : সম্রাট বাবর ছিলেন নিরলস কর্মী। কর্মই ছিল তার জীবনের ধর্ম। রাজ্য পরিচালনায় তিনি কখনও ক্লান্তি বোধ করতেন না।
শাসক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে তার চরিত্রে অসংখ্য সদগুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি শত বিপদেও কখনই বিচলিত হননি। মাঝে মাঝে তিনি কঠোর আচরণ করতেন সত্য, তবে তা ছিল সাময়িক।
৫. মহানুভব শাসক : বাবর ছিলেন স্নেহপরায়ণ, সদালাপী দয়ালু ও বন্ধুবৎসল। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, “সমসাময়িক মধ্য এশিয়ার ইতিহাসে বাবরের মহানুভবতা এক দৃষ্টান্তস্বরূপ।”
কথিত আছে, তার শৈশবের এক খেলার সাথীর মৃত্যুতে তিনি কয়েকদিন পর্যন্ত ক্রন্দন করেছেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি শত্রুদের প্রতিও তিনি সদ্ব্যবহার করতেন।
৬. জায়গিরদারদের ক্ষমতা খর্ব : বাবর স্বর্ণ সময়ে শাসনে সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার তেমন কোনো সংস্কার করতে পারেননি। তিনি বলবন ও আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থা বহাল রাখেন।
তিনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জায়গীরদার ও সাম্রস্ত ব্যবস্থার স্বীকৃতি দিলেও তিনি সামন্ত রাজা ও জায়গিরদারদের ক্ষমতা খর্ব করেন।
৭. প্রাদেশিক শাসন কাঠামো পুনর্গঠন : বাবর সিংহাসনে আরোহণ করে সঠিকভাবে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করার জন্য প্রাদেশিক শাসন কাঠামো পুনর্গঠন করেন।
বাবর প্রত্যেক প্রদেশে একজন দক্ষ ওয়ালি, দেওয়ান বা রাজস্ব কর্মকর্তা, শিকদার বা সামরিক কর্মকর্তা এবং কোতোয়াল বা নগর কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। এদের মাধ্যমে তিনি প্রশাসন পরিচালনা করেন।
৮. ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা : সম্রাট বাবর শাসন পরিচালনায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল ধরনের পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে প্রশাসনিক কাজে তিনি তুর্কি, আফগান ও হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। এমনকি তিনি তার দুই পুত্র হুমায়ূন ও কামরানকে হিন্দু রাজকন্যার সাথে বিবাহ দেন।
৯. তুর্কি ও আফগান শাসনের অনুকরণ : ১৫২৬ সাল থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত এ সামান্য সময়ে বাবর এক বিশাল স প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু রাজ্যশাসন পরিচালনার কোনো কৌশলই তার নিজের ছিল না।
কেননা সিংহাসনে আরোহণ করে তাকে বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহে কাটাতে হয়। তাই তিনি শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে তুর্কি ও আফগান শাসনের অনুকরণ করেন।
১০. শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক : বাবর ছিলেন শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে একজন কবি ছিলেন। তার রচিত ‘দেওয়ান’ তাঁর কাব্য প্রতিভার পরিচয় বহন করে। তাছাড়া বাবর রচিত তুজুক- ই-বাবরি বা বাবরের আত্মজীবনী সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অমূল্য সম্পদ।
১১. প্রজারঞ্জক শাসক : সম্রাট বাবর ছিলেন একজন প্রজারঞ্জক শাসক। তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য অনেক জনহিতকর কাজ করেন।
তিনি দিল্লিতে ২০টি উদ্যান, সেতু অট্টালিকা ছাড়াও পানিপথের কাবুলবাগ মসজিদ, সংবলের জামে মসজিদ এবং অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ নির্মাণ করেন।
১২. সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা : বাবর তুর্কি খলিফার শিথিল ক্ষমতাকে অস্বীকার করে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে নিজেকে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দু’বার রাজচ্যুত হয়ে সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন তা ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য আকবরের সময় এক বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়ে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়।
সিংহাসনে আরোহণ করার পর সারাক্ষণ যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে থাকার কারণে তিনি প্রশাসনকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলেও তিনি যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে যান তা অনুসরণ করে পরবর্তী মুঘল শাসকগণ মুঘল শাসনকে দীর্ঘায়ু করতে সমর্থ হন।
শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “শাসক হিসেবে বাবরের অবদান মূল্যায়ন কর” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।