HISTORY

সম্রাট হুমায়ুনের শেরশাহের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার কারণ কি?

1 min read

সম্রাট হুমায়ুন শেরশাহের বিরুদ্ধে ব্যর্থ হন কেন

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে হুমায়ূন এক অনন্য নাম। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মহামতি আকবরের পিতা।

তবে দুর্ভাগ্যবান মুঘল শাসক হিসেবেও হুমায়ূনের ইতিহাসে বেশ খ্যাতি রয়েছে। হুমায়ূন পৈতৃকসূত্রে মুঘল সাম্রাজ্য লাভ করলেও তা বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।

বিশেষ করে সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিনের মধ্যেই হুমায়ূন বেশ কিছু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন। তিনি এ সকল বাধা-বিপত্তি ভালোভাবে উতরাতে পারেননি। যার দরুন ১৫৩৯ সালে এবং ১৫৪০ সালে শেরশাহের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দুটি যুদ্ধে তিনি হেরে যান ।

– হুমায়ূনের ব্যর্থতার কারণসমূহ : হুমায়ূন ও শেরশাহের মধ্যে সংঘটিত চৌসার ও বিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হন এবং রাজ্যছাড়া হন।

নিম্নে হুমায়ূন ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. হুমায়ূনের অদূরদর্শিতা : শেরশাহের সাথে যুদ্ধে হুমায়ূনের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল হুমায়ূনের অদূরদর্শিতা। বাবর ভারতবর্ষে যে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

কেননা বাবর তার স্বল্পকালীন রাজত্বে বেশিরভাগ সময়ই যুদ্ধ বিগ্রহ করে কাটান। তাই নবপ্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান করা বাবরের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এজন্য নবগঠিত এ সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানের জন্য একজন কঠোর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসকের দরকার ছিল । যা হুমায়ূনের মধ্যে ছিল না।

২. ভাইদের অসহযোগিতা : হুমায়ূনের স্বীয় ভাইদের অসহযোগিতা হুমায়ূনের ব্যর্থতার জন্য আরেকটি কারণ। হুমায়ূনের তিন ভাই হুমায়ূনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।

কেননা তারা কেউই হুমায়ূনের সিংহাসন লাভকে ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাই শেরশাহের সাথে হুমায়ূনের যুদ্ধ লাগলে হুমায়ূন তার ভাইদের কাছে সাহায্য চাইলেও তার ভাইয়েরা কোনো সাহায্য করেননি।

৩. পরিকল্পনার অভাব : যদিও হুমায়ূন একজন নির্ভীক যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু শেরশাহের সাথে যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে হুমায়ূনের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

তিনি গুজরাটের সম্রাট বাহাদুর শাহকে দমনে দীর্ঘ সময় নেন। যার ফলে পূর্ব সীমান্তে শক্তিশালী হয়ে উঠা শেরশাহের বিরুদ্ধে হুমায়ূন তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

চুদার দুর্গে হুমায়ূন मীর্ঘ সময় আক্রমণ করতেন তাহলে শেরশাহ কোণঠাসা হয়ে পড়ত। কিন্তু হুমায়ূন অনেক পরে গৌড়ে পৌঁছান এবং সেখানেও দীর্ঘ সময় নেন।

এদিকে শেরশাহ বেনারস, জৌনপুর থেকে কনৌজ পর্যন্ত দখল করে হুমায়ূনের আগ্রায় পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দেন।

৪. আর্থিক শুন্যতা : আর্থিক শূন্যতা ছিল হুমায়ূনের ব্যর্থতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। হুমায়ূন তার পিতার কাছ থেকে সাম্রাজ্য লাভ করলেও রাজকোষ ছিল একেবারে শূন্য। এদিক থেকে হুমায়ূন আর্থিক অসচ্ছলতায় ভুগেন।

অন্যদিকে হুমায়ূন যে দশবছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তার পুরো সময়ই তিনি যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। এর ফলে রাজকোষ আরো শূন্য হয়ে যায়। এতে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং হুমায়ূনের পক্ষে যুদ্ধ করার কেউ ছিল না।

৫. অনভিজ্ঞ ও অনুপযুক্ত সৈন্যবাহিনী : হুমায়ূন পৈতৃকসূত্রে যে সৈন্যবাহিনী পান তা ছিল বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন লোক নিয়ে পঠিত। তাহাড়া সেনাবাহিনীতে দক্ষ সৈন্যের অভাবও ছিল।

বিলগ্রামের যুদ্ধের জন্য হুমায়ূন তাড়াতাড়ি যে সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ করেন তারা ছিল অনভিজ্ঞ ও যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত। তাছাড়া হুমায়ূনের সেনাবাহিনীতে নিয়মশৃঙ্খলারও অভাব ছিল।

বিভিন্ন জাতি নিয়ে গঠিত এ মুঘল সেনাবাহিনী জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজস্ব স্বার্থকে বড় করে দেখে। আর সেনাবাহিনীর এরূপ আচরণের কারণে হুমায়ূন যুদ্ধে হেরে যায়।

৬. চারিত্রিক দুর্বলতা : হুমায়ূনের চারিত্রিক দুর্বলতাই মূলত হুমায়ূনকে পরাজিত করে। যদিও বাবরের সাথে পানিপথের ও খানুয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে হুমায়ূন যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে হেরেমের সুখ এবং আফিমের প্রতি অত্যধিক আকৃষ্ট হওয়ায় তার চরিত্রের সদগুণগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন না। যার সুযোগ শেরশাহ পুরোপরিভাবে গ্রহণ করেন।

৭. উদাসীনতা : হুমায়ূন ছিলেন মুঘল শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদাসীন। শেরশাহের একের পর এক ক্ষমতা বৃদ্ধি হুমায়ূন ভালোভাবে আমলে না নিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দেন।

বিশেষ করে চতুর শেরশাহ হুমায়ূনের প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রকাশ করে হুমায়ূন তাতে বিশ্বাস করে এবং শেরশাহের প্রতি উদারতা দেখায়।

এজন্যই ভি.ডি. মহাজন বলেন, “He delay in taking action against Sher Khan resulted in his failure.” অর্থাৎ শেরশাহের প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্বের কারণেই হুমায়ূনের পতন ঘটে।

৮. মানসিক অস্থিরতা : হুমায়ূনের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ছিল প্রচুর। যার কারণে অনেকাংশে হুমায়ূনের পতন ঘটে। একমাত্র মানসিক অস্থিরতার কারণেই হুমায়ূন এক শত্রুকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও সমন না করে অপর শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতো।

যার ফলে তিনি কোনো শত্রুকেই চূড়ান্তভাবে দমন করতে পারতেন না। তিনি যদি প্রথমেই শেৱশহ সম্পূর্ণরূপে দমন করতেন তাহলে শেরশাহের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু মানসিক অস্থিরতার কারণে হুমায়ূন তা পারেননি।

৯. আত্মরক্ষামূলক নীতি : হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই আত্মরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করতেন। যা হুমায়ূনের পরাজয় ডেকে আনে।

চৌসার যুদ্ধের পর হুমায়ূন পুনরায় শেরশাহের বিরুদ্ধে বিলগ্রামে যে যুদ্ধ করেন সেখানে তিনি আক্রমণাত্মক নীতির পরিবর্তে আত্মরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করেন। যার ফলে শেরশাহ তার উপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পায় এবং তাকে পরাজিত করে।

১০. প্রজাদের অসহযোগিতা : হুমায়ূনের পরাজয়ের পিছনে প্রজাদের অসহযোগিতাও অনেকাংশে দায়ী। যেকোনো সম্রাটকে সিংহাসনে টিকে থাকার জন্য প্রজাদের সমর্থন দরকার কিন্তু হুমায়ূনের প্রতি প্রজাদের জনসমর্থন তেমন একটা ছিল না।

হুমায়ূনের খেয়ালিপনা ও অমিতব্যয়িতার কারণে হুমায়ূন  ক্রমান্বয়ে প্রজাদের সমর্থন হারাতে থাকে। যার ফলে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হুমায়ুনের পক্ষে তার প্রজারা এগিয়ে আসেনি যা হুমায়ূনের পতনকে অনিবার্য করে তুলে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, একজন সচতুর ও দূরদর্শী শাসক হওয়ার জন্য যেসকল গুণাবলি থাকা দরকার হুমায়ূনের মধ্যে তার একটিও ছিল না।

তাছাড়া হুমায়ূনের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও হুমায়ূনের অনুকূলে ছিল না। যার ফলে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় করা হুমায়ূনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এবং হুমায়ূনের নিজ ব্যর্থতার কারণে তাকে যাযাবর হতে হয়।

আরো পড়ুনঃ

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “সম্রাট হুমায়ুনের শেরশাহের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার কারণ কি?” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

5/5 - (38 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x