লুজান চুক্তি | লুজান চুক্তির পটভূমি, বিষয়বস্তু, উসমানীয় খিলাফত
লুজান চুক্তির ১০০ বছর
২৪ জুলাই ২০২৩ ঐতিহাসিক লুজান চুক্তির ১০০ বছর পূর্ণ হবে। এ প্রেক্ষাপটে জেনে নিন কেন, কোন কারণে চুক্তিটি করা হয় ।
লুজান চুক্তি
২৪ জুলাই ১৯২৩ সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে স্বাক্ষরিত হয় লুজান চুক্তি । লুজান শহরের নামানুসারে চুক্তির নামকরণ করা হয় লুজান চুক্তি । চুক্তিটির আনুষ্ঠানিক নাম Treaty of Peace & Exchange of War Prisoners with Turkey Signed at Lausanne। ১৪৩টি ধারাবিশিষ্ট চুক্তিটি লিখিত হয় ফরাসি ভাষায়।
২৩ আগস্ট ১৯২৩ তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি এটি অনুমোদন করে। এরপর ১৬ জুলাই ১৯২৪ অন্য রাষ্ট্রগুলোর আইনসভায়ও চুক্তিটি অনুমোদিত হয়।
৬ আগস্ট ১৯২৪ চুক্তিটি কার্যকর হয় । চুক্তির একপক্ষে ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা, অপরপক্ষে ছিল মিত্রশক্তির দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, জাপান, রোমানিয়া ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া।
পটভূমি
১৯১৯ সালে তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ২৩ এপ্রিল ১৯২০ তারা তুরস্কের এশিয়া অংশের আঙ্কারায় কনস্ট্যান্টিনোপলের বিকল্প সরকার হিসেবে ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ নামে একটি নতুন আইনসভা গঠন করে। এ সরকারের নেতা ছিলেন উসমানীয় সেনাবাহিনীর বিখ্যাত সমরনায়ক মুস্তফা কামাল পাশা ।
১০ আগস্ট ১৯২০ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তি উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে Treaty of Sévres স্বাক্ষর করে। সেইভ্রেস চুক্তির শর্তাবলি অত্যন্ত কঠোর এবং একপক্ষীয় হলেও সমগ্র উসমানীয় সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ মিত্রশক্তির দখলে থাকার কারণে তাদের প্রতি অনুগত থাকতে হয়।
আঙ্কারাভিত্তিক সরকার সেইড্রেস চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে গ্রিস, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং ১৯২০ ও ১৯২১ সালে যথাক্রমে আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে । ইতিহাসে এটি ‘তুর্কি ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। ১৯২০ সালে কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক উসমানীয় সরকারের সাথেও তাদের সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন আঙ্কারাভিত্তিক সরকারকে সহায়তা করে।
১৯২২ সালের অক্টোবরে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার গ্রিস, ফ্রান্স, আর্মেনিয়া ও কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক উসমানীয় সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হয় এবং আনাতোলিয়া উপদ্বীপ ও পূর্ব থ্রেস তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের হস্তগত হয়। ১১ অক্টোবর ১৯২২ উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
২৮ অক্টোবর ১৯২২ মিত্রশক্তি পুনরায় আলোচনার জন্য আঙ্কারার প্রধান কামাল আতাতুর্কের এবং উসমানীয়দের সুলতান মেহমেদ ষষ্ঠ ওয়াহিদউদ্দিনের কাছে চিঠি দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কামাল পাশা ১ নভেম্বর সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যান । তার সরকার লুজান চুক্তির আলোচনায় অংশ নেয় । দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে অবশেষে ২৪ জুলাই ১৯২৩ লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।
বিষয়বস্তু
লুজান চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। একই সাথে নির্ধারিত হয় গ্রিস, ইরান, সিরিয়া ও ইরাকের সীমানা। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তুরস্ক তার আগের আরব প্রদেশগুলোর ওপর কোনো দাবি জানাবে না এবং সাইপ্রাসে ব্রিটিশদের দখল এবং ডডেকানিজের ওপর ইতালীয় অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে।
অন্যদিকে মিত্ররা তাদের তুরস্কের কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে। সাথে সাথে তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বত্ব ত্যাগ করবে। আর তুরস্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করার দাবি ত্যাগ করবে মিত্র শক্তি এবং তুরস্কের আর্থিক বা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপাবে না ।
তুরস্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বসফরাস ও দারদানেলিস প্রণালি দিয়ে চলাচলকারী জাহাজ থেকে তুরস্কের টোল আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু পরে প্রণালি দুটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুইজারল্যান্ডের মন্ট্রিক্স শহরে আরেকটি চুক্তি হয় ২০ জুলাই ১৯৩৬। এই চুক্তিতে প্রণালিগুলোর কর্তৃত্ব পুরোপুরি তুরস্কের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয় ।
উসমানীয় খিলাফত
সেলজুক রাজবংশের জামাতা আর্তুগুল গাজি রোমের সেলজুক সালতানাতের নিযুক্ত সোগুত কেন্দ্রিক একজন আঞ্চলিক শাসক ছিলেন । তাকেই উসমানীয় খিলাফতের স্বপ্নদ্রষ্টা মনে করা হয়। তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা ।
প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে খিলাফতের নামকরণ করা হয় উসমানীয় খিলাফত। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের মাধ্যমে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল উসমানীয় খিলাফতের অধীন হয়। ১৬০০ ও ১৭০০ শতাব্দী ছিল উসমানীয় খিলাফতের উত্থানকাল। এ সময় উসমানীয় খিলাফত ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কিছু অনুগত রাজ্যে বিভক্ত ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১ নভেম্বর ১৯২২ উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্তি হলে খিলাফতের অধীন বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক অংশগুলো ৪৯টি স্বাধীন রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করে। শেষ সুলতান মেহমেদ ষষ্ঠ ওয়াহিদউদ্দিন ১৭ নভেম্বর ১৯২২ দেশ ছেড়ে চলে যান ।
সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এ সময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন। ৩ মার্চ ১৯২৪ খিলাফত বিলুপ্ত করা হলে উসমানীয় রাজবংশের প্রায় ৬০০ বছরের অধিক কালের শাসনের অবসান হয় ।