গণহত্যা বলতে কি বোঝায়?
ইংরেজি Genocide শব্দের বাংলা অর্থ গণহত্যা। শব্দটি গ্রিক Genos এবং ল্যাটিন Cide থেকে Genocide শব্দের উংপত্তি। Genos অর্থ জাতি আর Cide অর্থ গণ। শব্দটি ১৯৪৪ সালে প্রথম ব্যবহৃত হয়।
কোন নির্দিষ্ট জাতি বা জনগোষ্ঠীর সকল সদস্যকে ঘৃনিত আঘাতের শিকার করার যে প্রবণতা বা প্রক্রিয়া সেটাই জেনোসাইড। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নীতি মালায় গণহত্যার কোন সজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে ১৯৭৩ সালের আইনে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ‘‘একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, ভূতত্ত্বগত অথবা রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করার জন্য পরিচালিত কর্মকান্ড যেমন, বেছে বেছে হত্যা, শারীরিক মানসিক নির্যাতন, জন্ম অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, জোরপূর্বক কোন শিশুকে এক সম্প্রদায় থেকে অন্য সম্প্রদায়ে হস্তান্তর করাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।’’
জাতিসংঘ ১৯৪৯ সালের কনভেনশনে আন্তর্জাতিক আদালতে দোষীদের শাস্তির বিধান করে আইন প্রণয়ন করে। এ আইন মতে নিম্নের আচরণ সমূহ গণহত্যার পর্যায়ে পড়বে।
- কোন জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা।
- সাংঘাতিকভাবে কোন গোষ্ঠীর উপর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন।
- কোন জাতি বা গোষ্ঠীর উপর ইচ্ছাকৃত এমন জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া যা তাদের দৈহিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিনষ্ট করে।
- মানব জন্ম রোধের কোন ব্যবস্থা করা।
- কোন গোষ্ঠীর শিশুদের জোরপূর্বক অন্য গোষ্ঠীতে প্রেরণ।
জেনোসাইড শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন পোলিশ ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন। তিনি জেনোসাইড বলতে বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যা, পীড়ন ও আক্রমণকে বোঝান। এছাড়াও গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রচেষ্টা, সহযোগিতা এবং এর পক্ষে সরাসরি অথবা প্রকাশ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
গণহত্যার ইতিহাস
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের দ্বারা বহু গণহত্যা সংগঠিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাত থেকে। ইতিহাসের নৃশংসতম রাত বলা হয় এটাকে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর গ্রন্থ দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশে গণহত্যার বিষদ বিবরণ দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে হিটলার হলোকাস্টের মাধ্যমে প্রায় ১১ মিলিয়ন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ৬ মিলিয়ন বা ৬০ লক্ষ্য ছিল ইহুদি। বাকি ৫ মিলিয়ন ছিল ভবগুরের দল, সমকামী, প্রতিবন্ধী এবং রাজনৈতিক নেতা। ১৯৪৮ সালে হিটলারের আদেশে নাৎসি বাহিনী এই গণগত্যার পরিকল্পনা করে। হলোকাস্টের পূর্বে ইউরোপের ২০ টি দেশে প্রায় ৯ মিলিয়ন ইহুদির বসবাস ছিল। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনভাগের দুইভাগই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ইহুদিদের উপর গণহত্যা শুরু হয় ১৯৪১ সালে। এর জন্য পোল্যান্ডে ৬ টি পোলিশ ডেথ ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়।
জার্মানিতে ব্যাপকহারে গণহত্যা শুরু হয় ১৯৪২ সালে বানসিতে। এটাকে Final solution to the Jewish problem নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈনিকদের গনহত্যার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙ্গালি সৈনিক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ এবং আধা সামরিক আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় লোক, স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।
দ্যা রেইপ অব নানকিং
বর্তমানে জাপানকে বলা হয় সবচেয়ে ভদ্র ও সুসভ্য দেশগুলোর একটা। তবে একটা সময় জাপান ছিল সবচেয়ে বর্বর একটা জাতি। ইতিহাসের নৃশংসতম ও নির্মম গণহত্যা দ্যা রেইপ অব নানকিং এই ভদ্র জাপানিরাই চালিয়েছে।
১৯৩৭ সালে জাপানিরা চীন আক্রমণ করে। শুরু হয় জাপান-চীন যুদ্ধ। ডিসেম্বর মাসের আগেই চীনের সাংহাইয়ের পতন হয়। ১৩ ডিসেম্বর চীনের রাজধানী নানকিং এর পতন ঘটে। এরপর শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকান্ড। প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে চলা গণহত্যায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে নির্মমভাবে গণহত্যার করা হয়। রাজধানী নানকিং এর প্রায় অর্ধেক মানুষ এই গণহত্যার শিকার। এছাড়া প্রায় ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার নারীকে গণধর্ষণ করা হয়।
জাপানি সেনাবাহিনীর লোকেরা চীনা নাগরিক দেখলেই তাদেরকে গুলি করত এবং ধরে এনে জীবন্ত কবর দেওয়া হত। পুরুষদের দেওয়া হত অমানুষিক নির্যাতন। বেয়নেট চার্জ করে তাদের চোখ উপড়িয়ে ফেলা হত। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে পুড়িয়ে দেওয়া হত। ছোট বাচ্চাদের দুই পা ধরে চিরে দুভাগ করে ফেলত।
কম্বোডিয়ার গণহত্যা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম্বোডীয় গণহত্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। খেমাররুজরা দেশটিতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চার বছর ক্ষমতায় ছিল। এই চার বছরের ক্ষমতা থাকা অবস্থায় বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নামে প্রায় ২০ লাখ সাধারণ কম্বোডীয়কে হত্যা করে ক্ষমতাসীন খেমাররুজ সরকার। যে কেউ সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাকেই হত্যা করা হত।
বসনীয় গণহত্যা
সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯২ সালে দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। স্বাধীন হওয়ার পরপরেই বসনিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বসনিয়ার সার্বরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যায় প্রায় ১ লক্ষ্য মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া সার্বিয় সৈন্যদের হাতে হত্যা এবং ধর্ষণের শিকার হয় প্রায় ১ লাখ বসনীয় নারী।
রুয়ান্ডা গণহত্যা
রুয়ান্ডার অন্যতম দুটি প্রধান জনগোষ্ঠী হুতু ও তুতসি। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের পর বেলজিয়াম রুয়ান্ডা দখলে নেয়। তখন তারা তুতসিদের ক্ষমতায় বসায়। ১৯৬২ সালে যখন বেলজিয়াম এদেশ থেকে চলে যায় তখন তুতসিদের ক্ষমতা চলে যায় হুতু সম্প্রদায়ের কাছে। ক্ষমতা পেয়ে হুতুরা তুতসিদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতো। এক পর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব গৃহযুদ্ধে রুপ নেয়। হুতু সম্প্রদায় উগ্র জাতীয়তাবাদে মত্ত হয়ে তুতসিদের হত্যা করতে থাকে।
১৯৯৪ সালে ১০০ দিনের চলা এই হত্যাকান্ডে তুতসি সম্প্রদায়ের প্রায় ৮ লক্ষ্য নারী পুরুষ মারা যায় ক্ষমতাসীন হুতু সম্প্রদায়ের হাতে।