এক নজরে জামালপুর জেলা

জামালপুর জেলা যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম জেলা। নবগঠিত ময়মনসিংহ বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এটি। যমুনা বিধৌত জামালপুর জেলা মূলত অন্যতম কৃষিপ্রধান অঞ্চল হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। কৃষি পণ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে জামালপুর জেলা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি জেলা।

দেশের সবথেকে বড় সার কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার কোং লিমিটেড এই জেলাতেই অবস্থিত। যা কৃষি উৎপাদনে সারাদেশে ইউরিয়া সারের চাহিদার সিংহভাগ মিটিয়ে থাকে। সারাদেশের সঙ্গে রেল, নৌ ও সড়কপথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও জামালপুর জেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

জামালপুর জেলার আয়তন এবং জনসংখ্যা

জেলার মোট আয়তন ২০৩১.৯৮ বর্গকিলোমিটার। ৭৮৪ বর্গমাইলের জামালপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ।প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১২০০ জন।

জামালপুর জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০.৫৮ ভাগ পুরুষ এবং ৪৯.৪২ ভাগ মহিলা। এই জেলার শতকরা ৯৭.৭৪ ভাগ মানুষ মুসলিম ধর্মের অনুসারী, হিন্দু ধর্মের অনুসারী ১.৯২ ভাগ , খ্রিষ্টান ০.০৭ ভাগ, বৌদ্ধ ০.০৪ ভাগ এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী শতকরা ০.১৪ ভাগ মানুষ। উপজাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে গারো অন্যতম। তারা শেরপুর ও জামালপুরের গারো ও পাহাড়ি অঞ্চলে। বসবাস করেন। এছাড়াও হদি, কুর্মী এবং মাল এই জেলার অন্যতম উপজাতি।

ভৌগোলিক সীমানা

অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জেলার উত্তরে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা ও গারো পাহাড়। পূর্বদিকে অবস্থিত বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলা।
পশ্চিম দিকে অবস্থিত যমুনা নদী ও যমুনা বিধৌত সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলা। আর দক্ষিণ দিকে টাঙ্গাইল জেলা।

জামালপুর জেলার ইতিহাস

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় ভারতবর্ষে দিল্লির সম্রাট আকবরের রাজত্ব চলাকালীন সময়ে আরবদেশ থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন বহু ইসলাম ধর্ম প্রচারক।
ইয়েমেন থেকে আগমনকারী ইসলাম প্রচারক হযরত শাহ জামাল (রঃ) এই সময়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর জেলায় আগমন করেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম চালান। ইতিহাসবিদগণ ধারণা করেন যে, তাঁর নাম অনুসারেরই এই জেলার নামকরণ করা হয় জামালপুর।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জামালপুর জেলা ১১ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জামালপুর কে বৃহত্তর টাঙ্গাইল জেলা থেকে পৃথক করে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

জামালপুর জেলার প্রশাসনিক এলাকাসমূহ:

ঐতীহ্যবাহী জামালপুর জেলা সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত।
এগুলো হলো:

১. জামালপুর সদর
২. ইসলামপুর
৩. দেওয়ানগঞ্জ
৪. বকশীগঞ্জ
৫. মাদারগঞ্জ
৬. মেলান্দহ এবং
৭. সরিষাবাড়ি

জেলার প্রতিটি উপজেলার সাথেই রয়েছে ভালো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়াও সদরের সাথে ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ি উপজেলার সাথে রয়েছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।

জামালপুর জেলার ঐতিহ্য

বিভিন্ন বিখ্যাত জিনিসের জন্য জামালপুর জেলার খ্যাতি দেশজুড়েই। জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষি পণ্যের সবার কাছে এই জেলার একটি আলাদা পরিচয় রয়েছে।
এর মধ্যে দেওয়ানগঞ্জের জিল বাংলা সুগার মিলে উৎপাদিত চিনি, মেলান্দহে উৎপন্ন উন্নত মানের তামাক এবং তৈল। সদর উপজেলার বিখ্যাত বুড়িমার মিষ্টি, ছানার পায়েস এবং ছানার মিষ্টি ছাড়াও আনারস ও পানের জন্য এই এলাকার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।

জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় উৎপন্ন মাছ, দুধ ও সুস্বাদু ঘি এর কদর দেশজুড়েই। এছাড়াও বকশীগঞ্জের নকশীকাঁথা সারাদেশেই এই জেলাকে বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত করেছে। সরিষাবাড়ির যমুনা সার কারখানা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইউরিয়া সার কারখানা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। তাছাড়াও এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সোনালী আঁশ পাট, মরিচ, ধান ও শাকসবজি উৎপন্ন হয়।

কাসা শিল্প

জামালপুরের ইসলামপুরে প্রাচীনকালে গড়ে উঠা কাসার শিল্প সারাদেশেই বিখ্যাত। কাসার তৈরই আসবাবপত্র যেমন বাটি, প্লেট, জগ, গ্লাস, হুক্কা, বদনা এবং খেলনা সামগ্রী উল্লেখযোগ্য।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই শিল্প খুবই সমৃদ্ধ ছিল একসময়। সাধারণত হিন্দু সম্প্রাদায় এই কাসা শিল্পের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কযুক্ত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার কর্তৃক এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ঘরবাড়ি পুড়ে দেওয়ার পর এই শিল্প প্রায় ধ্বংসের দারপ্রান্তে চলে যায়। পরবর্তীকালে তাদের সন্তানসন্ততিরা চেষ্টা করলেও কাসা শিল্প আর আগের সেই জায়গায় যেতে পারেনি। বর্তমানে প্রায় ২০-২৫ টি পরিবার এই শিল্পের সাথে এখনও জড়িত রয়েছে।

নকশীকাঁথা শিল্প 

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বঁধুরা স্বভাবগতভাবেই গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য, সৃংস্কৃতিকে সুই সুতোর মাধ্যমে তাদের তৈরি কাথায় ফুটিয়ে তুলে আসছেন। তবে এই বিষয়টাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন জামালপুরের বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দহ অঞ্চলের বঁধুগন।

এখন সারাদেশেই তাঁদের তৈরি নকশীকাঁথার ব্যাপক চাহিদা বিদ্যমান। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বাণিজ্যিকভাবে নকশীকাঁথা তৈরি করা হচ্ছে। যা জেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জামালপুর জেলার মৃৎশিল্প:

জামালপুর জেলার শিল্প সমূহের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প।
মাটির তৈরই আসবাবপত্র, হাড়ি পাতিল, খেলনা, গৃহসজ্জার জিনিসপত্র এখন অনেক জনপ্রিয়।
পূর্বে মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, প্লেট, গ্লাসের চাহিদা সারাদেশে বিস্তৃত থাকলেও এখন তা বিলুপ্ত প্রায়।
তবে এখন গৃহসজ্জার জন্য বিভিন্ন আসবাবপত্রের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিক্ষা:

জামালপুর জেলা পূর্বে সকল ধরণের সুজোগ সুবিধায় পিছিয়ে থাকায় তেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেনি।
তবে বিগত দুই দশক থেকে এই জেলায় শিক্ষার হার বৃদ্ধি খুবই চমকপ্রদ। বর্তমানে এই জেলার শতকরা শিক্ষার হার প্রায় ৪০।

জামালপুর জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমুহের মধ্যে ১ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় – শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও ১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট নামে একটি সরকারি টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, একটি সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে।

পল্লী উন্নয়ন একাডেমি:

জামালপুর জেলায় শেখ হাসিনা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি নামে একটি সরকারি পল্লী উন্নয়ন একডেমি হয়েছে যা জেলার শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

এই জেলায় ৮ টি সরকারি কলেজ ছাড়াও ২০ টি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। ৭ টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ মোট ২৩১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় জেলার মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১১০ টি মাদ্রাসা, ৩৮ টি জুনিয়র হাইস্কুল, ৫৮৮ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৯০ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৭৬ টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল জামালপুর জেলার শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও জামালপুর জেলায় ১ টি হোমিওপ্যাথি কলেজ, ১ টি আইন কলেজ ও ১ টি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বিখ্যাত ব্যাক্তি বর্গ :

জামালপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিগণের মধ্যে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ, বীর বিক্রম শহীদ শাহজাহান, শহীদ আমানুল্লাহ কবির প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। যাদের অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করেছি স্বাধীনতা।

এছাড়াও কবি ও সাহিত্যিক হারুন হাবিব, কবি, সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান।
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, জনপ্রিয় অভিনেতা আমজাদ হোসেন এবং আব্দুল্লাহ আল মামুন।
প্রখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান উল্লেখযোগ্য।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, মৌলভী আব্দুল জব্বার পাহলোয়ান, ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, রাশেদ মোশারফ, রেজাউল করিম হীরা, আবুল কালাম আজাদ, মির্জা আজম, আব্দুল কাইয়ুম উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিত্ব।

দর্শনীয় স্থানসমূহ:

জামালপুর জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে হযরত শাহ জামালের মাজার, হযরত শাহ কামালের মাজার, যমুনা সার কারখানা, জিল বাংলা সুগার মিল উল্লেখযোগ্য। গারো পাহাড় লাওচাপড়া, মধুটিলা ইকো পার্ক, যমুনা নদীর তীর অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

এছাড়াও সদরের দয়াময়ী মন্দির, হরিশ চন্দ্রের দীঘি, গান্ধী আশ্রম, লুইস ভিলেজ পার্ক, যমুনা সিটি পার্ক, বাহাদুরাবাদ ঘাট, হাওয়াই রোড, খরকা বিল দর্শন করার জন্য উল্লেখযোগ্য স্থান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *