বুদ্ধিজীবী কারা? ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হ*ত্যাকান্ডের পটভূমি

বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড ওয়েডি সাইদ বলেছেন,
”There has been no major revolution in modern history without intellectuals; conversely, there has been no major counter-revolutionary movement without intellectuals. Intellectuals have been the fathers and mothers of the movement, and of course sons and daughters, even nephews and nieces”
তাঁর মতে, যে কোন ধরনের বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব বুদ্ধিজীবী ছাড়া সংঘটিত হয় না। বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে বিপ্লবের প্রাণ। পৃথিবীর যেকোন সরকার বা রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রয়োজনে বুদ্ধিজীবী মহল সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এর ভিন্ন চিত্রে কিছু বুদ্ধিজীবী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠে।
প্রায় সময় সরকারের বিরদ্ধে অবস্থান নেওয়া বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন হামলা, মামলা এমনকি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কারণ তাদেরকে মারলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অন্য কেউ আর সাহস করবে না। তাই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে তাদেরক পড়তে হয়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ও ১৪ ডিসেম্বর সহ ৯ মাস ব্যাপী বুদ্ধিজীবী হত্যা। অপরাশেন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক, এবং বুদ্ধিজীবী মহলকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।

বুদ্ধিজীবী কারা?

তবে এই বুদ্ধিজীবী আসলে কারা এই নিয়ে অধিকাংশ সময় মতপার্থক্য ও তর্ক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বুদ্ধিজীবী কাদেরকে বলা হয়? বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষ’’ গ্রন্থ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীর অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাধিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারী বেসরকারী কর্মচারী, চলচ্ছিত্র ও নাটক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবি ও সংস্কৃতি সেবী’’।
তবে সাধারণ ভাবে বুদ্ধিজীবী বলতে ব্যক্তির পেশা, শিক্ষা, এবং জীবনাদর্শর মাধ্যমে যারা সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। এদের মধ্যে লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, দার্শনিক, সাংস্কৃতিককর্মী, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বুদ্ধিজীবীর আওতাভুক্ত হয়।
দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, শহিদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, সাহিত্যিক ৯ জন, এবং প্রকোশলী ৫ জন।

১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পটভূমি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণ উদঘাটন করতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে পাকিস্তান শাসনের ২৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। দেশভাগের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অনেক। জমিদারি প্রথা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিলুপ্তি এবং সেই সাথে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল।
তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে বের হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় উর্দুভাষা চাপিয়ে দেয়। তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। উর্দু, আরবী ও ফারসি ভাষার সমন্বয়ে বাংলা ভাষাকে মুসলমানি চেহারা দিতে গিয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখিন হতে হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এর সমালোচনা করে।
জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক প্রশাসনের চোখেও বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে সাংবাদিক মহল এবং বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দমন নিপীড়নের শিকার হয়। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ কখনো থেমে থাকেনি।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকীর আয়োজনকে ঘিরে পাকিস্তানি সরকার অনুষ্ঠান বানচাল করতে চেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানের আদর্শ বিরোধী অভিহিত করে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালায়। তখন সরকারের এরুপ মনোভাবের বিপরীতে বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা রবীন্দ্রজয়ন্তি আয়োজনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুথানের সময়ও  বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলের বড় অংশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বুদ্ধিজীবীদের উপর আক্রোশের প্রধান কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবিরোধী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পনা করেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কারণ বুদ্ধিজীবীরা এদেশের প্রায় সকল পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানিদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা। ২৫ মার্চ থেকে ডিসেম্বরে আত্ম সমর্পনের আগ পর্যন্ত বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার,শিক্ষক, গবেষক ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তারা মনে করেছিল যুদ্ধে জেতার পরও এই জাতি যেন আর মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘‘রেইপ অব বাংলাদেশ’’ গ্রন্থে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন।

Similar Posts