International

ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি | ফরাসি বিপ্লবের কারণ

1 min read
১৭৮৯ সালে শুরু হওয়া ফরাসী বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ফরাসী রাজতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের মতো প্রাচীন প্রথার লালন করার ফলে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে আসছিল। এছাড়া রাজা ষোড়শ লুই এর দুর্বল অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপক অসন্তোষের কারণেই মূলত সংগঠিত হয় এই বিপ্লব।
রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন ফ্রান্সের রাজ বংশের শেষ রাজা। তিনি ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আরোহন করেন। রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দুর্বল,এবং ভোজন বিলাসী। তিনি প্রথম রাণী মাদাম দ্য তুসোর নিয়ন্ত্রণাধীন ও দ্বিতীয় রাণী মেরী এন্টোয়নেটের প্রভাবাধীন ছিলেন।
যাইহোক, যে কোন বিপ্লব তাৎক্ষণিক শুরু হয় না। বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয় বহু বছরের অসন্তুষ্ঠ ও নিপীড়ন থেকে। চলুন দেখে নেওয়া যাক ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পিছনের  কারণ সমূহ।

ফরাসি বিপ্লবের কারণ

ফরাসি বিপ্লবের শুরুতে ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থা যাজক শ্রেণী, অভিজাত শ্রেণী ও তৃতীয় শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলো। যাজকেরা ছিল প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিলো প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার। তবে এই যাজক শ্রেণীতেও ছিলো চরম ভেদাভেদ। উচ্চ যাজক ও নিম্ন যাজক এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল তারা।
সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিলো অভিজাত সম্প্রদায়। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে অভিজাতদের সংখ্যা ছিলো আনুমানিক তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার এর মতো। এরা ছিলো বংশ মর্যাদায় সবার থেকে উচ্চ। স্বয়ং রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন এই অভিজাত সম্প্রদায়ের। সুতরাং অভিজাতরাই সবসময় নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক।
অভিজাত সম্প্রদায়ও বিভিন্ন জাতে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন বনেদী ঘরের অভিজাত এবং গ্রামীণ বুর্জোয়া অভিজাত। রাজার সভাসদ, সেনাপতি ও বিচার বিভাগের পদ, রাজার মন্ত্রিপরিষদ, আইন পরিষদ, রাষ্ট্রদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, এবং সামরিক বিভাগের ইত্যাদি উচ্চপদ গুলোর অধীকারে থাকতো প্রাচীন বনেদী ঘরের অভিজাতদের দখলে। দ্বিতীয়ত ছিল গ্রামীণ অভিজাত সম্প্রদায়। এরা বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের জমিদার শ্রেণী এবং প্রাদেশিক সভায় প্রতিপত্তি খাটাতো।
তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক ছিল সবচেয়ে বেশি। বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর ছিলো মূলত তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিলো ২৫ মিলিয়ন। যার মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগ ছিলো এই তৃতীয় শ্রেণীর সাধারণ জনগোষ্ঠী।
ফ্রান্সের বিপ্লবপূর্ব সমাজ ব্যবস্থা অধিকারভোগী ও অধিকারহীন এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলো। দেশের ভূ-সম্পত্তির শতকরা ৪০ শতাংশই সুবিধাভোগী বা অধিকারভোগী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এরা কর দিতে চাইতো না। যাজকরা খুব কমই কর দিতেন। যার ফলে করের সম্পূর্ণ বোঝা গিয়ে পড়ে অধিকারহীন শ্রেণী অর্থাৎ কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর।
এরকম ব্যবস্থা ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রধান কারণ। ফ্রান্সে তিনটি প্রধান কর ছিলো ভূমি কর, আয়কর এবং উৎপাদন কর। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজার সাথে যাজক শ্রেণীর পৌ-ইসির চুক্তি হওয়ায় তাদের উপর কর আরোপ করতে পারতেন না। অভিজাতরাও প্রায় সময় আয়কর এবং উৎপাদন কর সুকৌশলে এড়িয়ে যেত।
তিনটি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও ফ্রান্সের রাজা লবণ শুল্ক, বাণিজ্য শুল্ক প্রভৃতি কর আদায় করতো। রাজার কর আদায়ের একমাত্র উৎস ছিলো তৃতীয় শ্রেণী। ফলে তৃতীয় শ্রেণী করের যোগান দিতে গিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। তখন করবৃদ্ধির সাথে সাথে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি যেন প্রকট হয়ে ওঠে। একেই চতুর্দিকে কর দিতে দিতে নাজেহাল তার উপর বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন জনজীবনের নাভিশ্বাস আরো বাড়িয়ে তোলে।
ফ্রান্সের অর্থনীতির ঘোর অন্ধকারময দিক হলো রাজকোষের অনিয়মিত ব্যবহার। ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ছিল যাদের মধ্যে ১৬ হাজার কর্মচারী ছিলো কেবল রাজপ্রাসাদের কাজের জন্য। রাণীর খাস চাকরের সংখ্যা ছিলো ৫০০ জন। রাণী নিত্য-নতুন ভোজসভার আয়োজন ও পোশাকের পিছনে প্রচুর খরচ করত।
ষোড়শ লুই ছিলেন দূর্বল চিত্ত শাসক। তাঁর সময়ে রাজতন্ত্রে অবক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সেকারণে তিনি পত্নী, অভিজাত, সভাসদ ও মন্ত্রী কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। ফরাসি বিপ্লবের গতি যেমন ছিলো বৈচিত্র্যময়, তেমনই ছিলো ব্যাপক। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ লুইয়ের পর ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
পিতার ন্যায় তিনিও স্বেচ্ছাচারী পথ অবলম্বন করেছিল। রাজা ছিল তার দুই স্ত্রী মেরী এন্টোয়নেট ও মাদামতুসোর ক্রীড়নক। ক্রমাগত বহিঃশত্রুর মোকাবেলা ও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ফলে ফ্রান্সের রাজকোষ অচিরেই শূন্য হয়ে পড়ে।
অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জনসাধারণের উপর করবৃদ্ধি ছাড়া ফ্রান্সের অচলাবস্থা কাটানো অসম্ভব ছিল। এই সংকটময় অচলাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাজা অর্থমন্ত্রি টুর্গোকে সংস্কারের নির্দেশ দেয়। টুর্গো ছিল একজন দক্ষ ও সাহসী অর্থমন্ত্রী। তিনি ফ্রান্সে অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন ও কৃষকদের উপর থেকে বিশেষ কর উচ্ছেদের ঘোষণা দেয়।
ফলে তিনি অভিজাতবর্গের বিরাগভাজন হন। অভিজাত শ্রেণীরা অর্থমন্ত্রির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। তাঁদের চাপে রাজা অর্থমন্ত্রি টুর্গোকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। ১৭৭৬ সালে নেকারকে নতুন করে অর্থমন্ত্রি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতিতে ব্যয় সংকোচন নীতি প্রবর্তন ও ভূমি সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু আবারও অভিজাত শ্রেণীর চাপের মুখে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
এরপর ক্যালোনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সরকারের আয়ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য অভিজাত ও যাজক শ্রেণী উপর কর ধার্যের প্রস্তাব পেশ করেন। এছাড়া তিনি বাধ্যতামূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ ও লবণ কর সকল শ্রেণীর উপর আরোপের প্রস্তাব দেন।
তাঁর এ প্রস্তাব জনসাধারণের নিকট প্রশংসিত হলেও অভিজাতরা এর বিরোধিতা করেন। ষোড়শ লুই ক্যালোনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গণ্যমান্য অভিজাতদের সভা ডাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু গণ্যমান্যরা সুবিধাভোগী থাকায় প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে। নিরুপায় রাজা ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী ক্যালোনকে পদচ্যুত করেন।
ক্যালোনের পরে অর্থমন্ত্রী করা হয় ব্রিয়েনকে। পরিস্থিতির চাপে তিনি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ব্রিয়েন রাজার নির্দেশ অনুসারে আর্থিক সংস্কারের প্রস্তাবনা পার্লামেন্টে পেশ করলে এ প্রস্তাবও প্যারিসের পার্লামেন্ট নাকচ করে দেয়।
5/5 - (11 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x