আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ

আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন মূলত উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ শাসিত ১৩টি উপনিবেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা থেকে সৃষ্টি হয়। ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে লেক্সিংটন এবং কনকর্ডে ব্রিটিশ সৈন্য এবং উপনিবেশ সৈনিকদের মধ্যে সংঘর্ষ পরবর্তীতে সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা করে। স্থানীয় বিদ্রোহীরা ‍উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে স্বাধীনতার ডাক দেয়।
ফ্রান্স সরকার ১৭৭৮ সালে উপনিবেশিক এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয় এবং চলমান গৃহযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে পরিণত করে। যুদ্ধটি পরবর্তীতে স্পেন ও ফ্রান্সের যোগদানে তা ইউরোপ সহ ক্যারবীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসিদের সহায়তায় ১৭৮১ সালে কন্টিনেন্টাল আর্মি ব্রিটিশদের ভার্জিনিয়ার ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করলে আমেরিকানরা স্বাধীনতা লাভ করে। যদিও যুদ্ধটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ

বিপ্লব শুরু হওয়ার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উপনিবেশিক ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। ১৭৫৬-৬৩ সালের ফরাসীদের বিরুদ্ধে সাত বছরের যুদ্ধ ব্রিটিশ শাসনে নতুন নতুন অঞ্চল নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। তবে ব্যয়বহুল এই সংঘাতের ফলে অনেক অর্থ ও রসদের খাটতি দেখা দেয়। এই খাটতি মেটাতে উপনিবেশ প্রদেশগুলোতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ করের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া ১৭৬৫ সালের স্ট্যাম্প অ্যাক্ট, ১৭৬৭ সালের টাউনশ্যান্ড অ্যাক্টস এবং ১৭৭৩ সালের চা আইনের মাধ্যমে শোষণ করতে থাকে। ট্যাক্স বা করের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের প্রচেষ্টা বহু উপনিবেশের মধ্যে তীব্র অসন্তেুষ্ট দেখা দেয়। এই কর আরোপের কারণে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের বেআইনিভাবে দেখত।
এছাড়া আইন করে ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য ইউরোপীয় দেশ থেকে কোন কিছু সরাসরি কেনার ক্ষেত্রে নিষোধাজ্ঞা প্রদান করে। সুগার অ্যাক্ট আইন পাশ করে চিনির আমদানির উপর করের হার ২.৫ তেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করে। কারণ উপনিবেশিকরা ফরাসি উপনিবেশ কানাডা থেকে সস্তায় চিনি আমদানি করত কিন্তু সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ে কানাডা ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমেরিকায় মদের দাম বেড়ে যায়। এর ফলে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের উপর ক্ষুব্ধ হতে থাকে।
১৭৬৫ সালে পাশ করা স্ট্যাম্প এর মাধ্যমে আমেরিকার যেকোন দলিল, চুক্তিপত্র এবং লাইসেন্স ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কিনতে হবে। যদিও পরবর্তীতে আইনটি বাতিল করা হয়।
১৭৭০ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সৈন্যদের প্রতিরোধের কারণে বহু স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ সৈন্যরা উপনিবেশিদের প্রতিরোধের গুলি চালালে পাঁচ জন মারা যায়। ইতিহাসে এই হত্যাকে বোস্টন গণহত্যা বলে অভিহিত করে। হত্যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে একদল উপনিবেশিক প্রতিনিধি যেমন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন এবং স্যামুয়েল অ্যাডামস, প্যাট্রিক হেনরি এবং জন জে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ জানাতে ১৭৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফিলাডেলফিয়ায় মিলিত হন।
কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, বিনা প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই অতিরিক্ত কর আদায়ের  পাশাপাশি উপনিবেশগুলিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ। কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস আরও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবেচনায় ১৭৭৫ সালের মে মাসে বৈঠকে মত দেয়। কিন্তু ততক্ষণে সহিংসতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৭৫ সালের এপ্রিলের কয়েকশ ব্রিটিশ সেনা বোস্টন থেকে ম্যাসাচুসেটস-এর নিকটবর্তী কনকর্ডে উপনিবেশিক মিলিশিয়ারা ব্রিটিশ বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য একত্রিত হতে শুরু করে। ১৯ এপ্রিল, ম্যাসাচুসেটস এর লেক্সিনটন এবং কনকর্ডের যুদ্ধে স্থানীয় মিলিশিয়ারা ব্রিটিশ সেনাদের সাথে সংঘর্ষ লিপ্ত হয়। এর মাধ্যমে বিপ্লব সূচনার শুরু হয়।
ফিলাডেলফিয়ায় দ্বিতীয় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস বসলে প্রতিনিধি বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এবং টমাস জেফারসন সহ কন্টিনেন্টাল আর্মি গঠনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ১৭ জুন বিপ্লবের প্রথম লড়াইয়ে উপনিবেশিক বাহিনী বোস্টনের ব্রিডস হিলের জেনারেল উইলিয়াম হাওয়ের ব্রিটিশ বাহিনকে প্রচুর হতাহত করেছিল যা বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৭৭৬ সালের জুনের মধ্যে বিপ্লব পুরোদমে শুরু হওয়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান সহিংসের মধ্যে উপনিবেশিকরা ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার পক্ষে মত দেয়। ফলে ৪ জুলাই, ১৭৭৬ সালে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। জর্জ ওয়াশিংটনকে প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং টমাস জেপারসনের রচিত ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে অবশেষে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
প্রায় ৮ বছর ধরে চলা আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন অবশেষে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়।

Similar Posts