দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ

১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ মহাদেশে যে চরম অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছিল তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর হারে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। তখন জার্মানীতে ক্ষমতায় বসে নাৎসি পার্টির প্রধান নেতা অ্যাডলফ হিটলার
ভগ্নদশা থেকে জার্মানীকে পুনরুদ্ধার এবং বিশ্ব আধিপত্যের বিস্তারের জন্য হিটলার ইতালি ও জাপানের সাথে কৌশলগত একটি সামরিক চুক্তি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় এবং ভার্সায় চুক্তির অপমানজনক শর্তের কারণে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

হিটলার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ডে আক্রমণ করলে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা তৈরি হয়। ফলে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় ‘‘Total war’’ বা সর্বাত্মক যুদ্ধ। অতীতের যেকোন যুদ্ধের তুলনায় ২য় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মরণাস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে এত ভয়াবহ যুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি নেই। ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধটি কেন বিশ্বযুদ্ধে রুপ নিয়েছিল তা জানব আজকের আলোচনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নির্মম হারের যন্ত্রণা জার্মানীদের উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে আকৃষ্ট করে। তারা মনে করত জার্মানরাই পৃথিবীতে একমাত্র পিওর জাতি। এর ফলে তারা ইহুদি বিদ্বেষ লালন করত এবং ইউরোপ থেকে এই ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করে।
১৯৩৪ সালে হিটলার জার্মানির প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলরের দায়িত্ব লাভ করে। হিটলার জার্মান রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের জন্য এক কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। তার মতে জার্মান ভাষাভাষি সমস্ত জনগনকে জার্মান রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর জন্য চাই রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করা।ইতালি ও জাপানের সাথে জার্মান জোটবদ্ধ হয়। হিটলার ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া দখল করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ

১৯৩৯ সালের আগস্টের শেষের দিকে হিটলার এবং সোভিয়েত নেতা স্টালিন জার্মান-সোভিয়েত অনাক্রমণ এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। হিটলার দীর্ঘদিন ধরে পোল্যান্ড আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাই ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় এবং এর মাধ্যমে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর, সোভিয়েত সৈন্যরা পূর্ব থেকে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের আক্রমণে পোল্যান্ড দ্রুত পতন ঘটে। তবে ১৯৪০ সালে, জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে পরস্পর বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৪০ সালের ৯ এপ্রিল, জার্মানি নরওয়ে আক্রমণ করে এবং সেই সাথে ডেনমার্ক দখল করে ফেলে। ১০ ই মে, জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ড অভিযান চালায়। যুদ্ধে  পরাজিত করে ভার্সাই সন্ধি অনুসারে বেলজিয়ামকে দেওয়া এলাকাগুলি পুনরায় জার্মান সৈন্যগণ দখল করে নেয়।
এরপর জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্স আক্রমণ করে। ফরাসি প্রতিনিধিগণ জার্মান সেনাপতি কাইটেলের কাছে আত্মসমর্পন করে। এর মাধ্যমে জার্মান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হাতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়। ফ্রান্স পতনের পর ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি হিটলারের সাথে একটি জোট গঠন করে। তখন ইতালি ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
জার্মান বাহিনী ১৯৪০ সালে, ব্রিটেনে ব্যাপক বোমা হামলা করে। কিন্তু ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স শেষ পর্যন্ত জার্মান বিমানবাহিনীকে পরাজিত করে এবং হিটলার আক্রমণ পরিকল্পনা স্থগিত করে দেয়। হিটলার আফ্রিকায় ইংরেজদের প্রতিহত করার একটি সংকল্প করে। এর জন্য ইতালি ব্রিটিশ শাসিত সোমালিল্যান্ড দখল এবং মিশর ও সুয়েজখালের অধিকার নিয়ে নেয়। এর মাধ্যমে আফ্রিকায় ব্রিটিশ প্রভাব কমে পায়।
১৯৪১ সালের হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া অক্ষ শক্তি জোটে যোগ দেয়। এরপর জার্মান সেনারা যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিসকে পরাস্ত করে দখল করে।

হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণ

জুন, ১৯৪১ সালে, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার আদেশ দেন। হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ‍উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। মাত্র দু বছর পূর্বে হওয়া জার্মান-সোভিয়েত অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করে। জার্মান সেনাপতি পাইলাসের অধীনে জার্মান বাহিনী রুশ সীমান্ত অতিক্রম করে ঝড়ের গতিতে মস্কোর দিকে ছুটে যায়।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মস্কো অবরুদ্ধ করে জার্মান বাহিনী। কিন্তু প্রবল শীতের প্রকোপে জার্মান বাহিনী একপ্রকার দিশেহারা হলে এই সুযোগে রুশ বাহিনী জার্মানদের প্রবলভাবে আক্রমণ করে । ফলে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারী মাসে, জার্মান সেনাপতি রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান
 
৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে জাপানের ৩৬০ টি বিমান হাওয়াই দ্বীপে পার্ল হারবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং দ্বীপ সমূহ তাদের দখল করে নেয়। পার্ল হারবার আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকানদের যুদ্ধে প্রবেশের পক্ষে কাজ করেছিল।
যার ফলে ৮ ই ডিসেম্বর, মার্কিন কংগ্রেস জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর প্রতি উত্তরে জার্মান এবং অন্যান্য অক্ষ শক্তিগুলি তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়।
১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বাহিনী ইতালিকে পরাজিত করে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয় এবং মিত্রশক্তি জোটের দিকে চলে য।
জার্মানির আত্মসমর্পন ও কিনাওয়া দ্বীপের অধিকার হারার ফলে জাপানও যুদ্ধে পিছু হাটতে বাধ্য হয়। ১৯৪৫ সালে মিত্রপক্ষের এক সভায় জাপানকে আত্মসমর্পনের জন্য আহবান করে কিন্তু জাপান তাতে কর্ণপাত না করলে আমেরিকান বাহিনী আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখে জাপানের বিখ্যাত দুটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক হামলা করে। ফলে সর্বশেষ জাপান আত্মসমর্পনে সম্মত হয়।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ সালে জাপান মিত্রশক্তির নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করলে  ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের সমাপ্তি হয়।