আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনা থেকেই একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। শুরু থেকেই ভাষা কেন্দ্রীক সমস্যা ছিল পাকিস্তানের প্রধান সমস্যা।
এছাড়া শাসন কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে পরিচিত সংবিধান প্রণয়নে ছিল ধীর গতি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারন করে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। এর সাথে কতিপয় পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে,
  • ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল ঘোষণা।
  • পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল।
  • সকল প্রকার রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ।
  • পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া।
  • জেনারেল আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের নতুন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করা।
এসকল ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়। ২৪ অক্টোবর, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানকে প্রধানমন্ত্রির হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে একটানা ১০ বছর পাকিস্তান আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের চলতে থাকে।
 
পটভূমি
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক শাসন, রাজনীতিবিদ, বিত্তবান এবং সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের অশুভ পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের মাধ্যমে পাকিস্তানের এলিট গোষ্ঠী নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে। কিন্তু গণতন্ত্র তাদের অশুভ পরিকল্পনায় বাঁধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা গণতন্ত্রকে কলুষিত করে রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ তৈরি করে।
১৯৫৪ সালের প্রদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের পরাজয়ে পাকিস্তানের এলিট শ্রেণীর মধ্যে একটি আতংক বিরাজ করে। ফলে এলিট গোষ্ঠী নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারকে সুকৌশলে হঠানোর পায়তারা করে। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। আওয়ামী লীগের আকষ্মিক এই জয়ে এলিটরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। এর জন্যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়।
ফলশ্রুতিতে প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের মূখ্যমন্ত্রি এ. কে. ফজলুল হককে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সেই সাথে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন কায়েম করা হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে যাওয়া এবং পাকিস্তানে বারবার সরকার পরিবর্তন জনসাধারণের মাঝে সরকার বিদ্ধেষ দেখা দেয়।
সামরিক এলিট গোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, ক্ষমতায় যেতে হলে আগে গণতন্ত্র বিনষ্ট করতে হবে এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনপ্রিয়তা লোপ করে দিতে হবে। ফলে তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গাম লাগাতে থাকে। এছাড়া দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট ও রাজনীতিবিদদের একে অপরের প্রতি বিদ্ধেষ ছড়িয়ে দিয়ে সামরিক শাসনের পথ তৈরি করে।
১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে বাক বিতন্ডা দেখা দেয়। সংসদে স্পীকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে উভয় দল ঝগড়া লাগলে এক পর্যায়ে স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। এতে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী সংসদ অধিবেশন কার্যক্রম পরিচালিত করে।
এক সময় সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেলে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। ডেপুটি স্পীকার মাথায় আঘাত পাওয়ার তিনদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এই অপ্রীতিকর হত্যাকান্ডকে উপলক্ষ্য করে ৭ অক্টোবর সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করে একটি ঘোষণা দেয়। এই ঘটনায় ইস্কান্দার মির্জা বলেন, ‘‘আপনারা স্পীকারকে আঘাত করে হত্যা করে এবং জাতীয় পতাকার অবমাননা করে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন নি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মন মানসিকতা এতই নীচে নেমে গেছে যে, বিশ্বাস হচ্ছেনা, নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান গোলযোগপূর্ণ অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’’

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য

১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর, ক্ষমতা গ্রহণ করে পরের দিন এক সামরিক অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে প্রচলিত মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার পরিবর্তে একমাত্র রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার চালু করে। প্রেসিডেন্ট সহ মোট ১২ জন সদস্য নিয়ে আইয়ুব খানের প্রথম মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।
নতুন গঠিত সামরিক প্রশাসনকে সাজাতে তিনি কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, Elective Bodies (Disqualifications) Order বা EBDO এবং Public Office (Disqualification) Order 1559  জারি করেন। প্রথম আইনের মাধ্যমে সকল রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে, এবং দ্বিতীয় আইন দিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির শাস্তির ব্যবস্থা করেন।
আইয়ুব খান ক্ষমতা লাভের পরপরেই পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার লড়াই ইত্যাদি অভিযোগ এনে প্রায় ১৫০ জন মন্ত্রী, এবং প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা হয়। এছাড়া প্রায় ৬০০ জন সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার দোষে অভিযুক্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। অভিযুক্তদের বিচারের জন্য পাকিস্তানের দুই প্রদেশে দুটি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়।
রাজনীতিবিদরা যদি ট্রাইবুনালের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে দেশের যে কোন নির্বাচিত সংস্থার সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে সিভিল কর্মকর্তা, পুলিশ, পরারাষ্ট্র দফতর, প্রাদেশিক কর্মকর্তা সহ প্রায় ১৭০০ জনকে আজীবন বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেন তিনি।
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রবর্তন
 
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম সংস্কার ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থা। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর, মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রদানের পরিবর্তে নির্ধারিত কিছু সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এটি ছিল একটি চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসন। ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, এবং বিভাগীয় কাউন্সিল এই চার স্তর নিয়ে স্থানীয় শাসন কাঠামো গঠিত হয়। এছাড়াও রয়েছে,
১৯৬২ সালে সংবিধান প্রণয়ন
শিক্ষা কমিশন গঠন
সাংস্কৃতিক বাধাগ্রস্ত

Similar Posts