ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা লেগেই থাকত। শাসনতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং দুই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈষম্য একসময় প্রকট আকার ধারণ করে।
এতসব সমস্যার মধ্যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় বলা চলে।
১৯৫৮-৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তান ছিল সামরিক শোষণের জর্জরিত দেশ। আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে জনগণের নিকট কলুষিত করে তাঁর সামরিক শাসনকে বৈধতা করে নেয়। তাঁর ১০ বছরের শাসনে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে মানুষকে বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে রাখে। EBDO এবং PODO 1959 আইন জারি করে রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ সালে আঁগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর জানুয়ারীতে পুলিশ কর্তৃক শহিদ আসাদ হত্যা, ১৫ ই ফেব্রুয়ারিতে আগরতলা মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে জেলে হত্যা, এবং ১৮ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শিক্ষিকা ড. জোহান হত্যা ইত্যাদি কারণে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ, প্রবল আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেই সাথে পাকিস্তানের দীর্ঘ ১০ বছরের সামরিক শাসনের অবসান হয়।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট
সামরিক শাসক আইয়ুব খান দেশদ্রোহীতার নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করলে পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা বাতিল এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
দেশজুড়ে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং অন্যন্য ছাত্র সংগঠগুলো মিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও ১১ দফা দাবী
ছাত্র পরিষদ ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারী, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে স্বীকৃতি দিয়ে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। এগারো দফা দাবিগুলো হচ্ছে,
- হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত হতে হবে, কলেজ সমূহকে প্রাদেশিকীকরণ নীতি ত্যাগ করতে হবে, ছাত্রদের বেতন কমানো এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিকি ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, শিক্ষার মাধ্যম এবং অফিস আদালতের ভাষা বাংলা করতে হবে।
- প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন করে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে।
- পূর্ব বাংলাকে ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে যুক্তরাষ্ট্র পদ্ধতির, যেখানে আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সর্বোচ্চ। ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, মুদ্রা সরবরাহ।
- বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, এবং সিন্দু প্রদেশ সহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি সাব-ফেডারেল গঠন করতে হবে।
- ব্যাংক, বীমা, ইন্সুরেন্স, এবং বড় বড় শিল্পকলকারখানাকে জাতীয়করণ করতে হবে।
- কৃষকদের থেকে খাজনা হ্রাস সহ যাবতীয় বকেয়া মহকুফ এবং সনদ প্রথা বাতিল করতে হবে।
- শ্রমিকের যথাযথ মজুরি প্রদান এবং বোনাস দিতে হবে।
- পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের যথাযথথ ব্যবহার নিশ্চিত কর েহবে।
- জরুরী আইন, নিরাপত্তা আইন সহ সকল ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করতে হবে।
- স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে সিয়েটো, সেন্টো, এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করতে হবে।
- পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে আটককৃতদের মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার, এবং আগরতলা মামলা সগ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র পরিষদ কর্তৃক এই ১১ দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশ ব্যাপী ছাত্র আন্দোলন নতুন মোড় নিতে শুরু করে। সেই সাথে পাকিস্তানের সর্বত্র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণ
ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি বা DAC গঠন
১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রীক। কিন্তু ১৯৬৯ এর মাঝামাঝি থেকে কৃষক, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং অন্যন্য গোষ্ঠী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। ফলে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গণআন্দোলনে রুপ নেয়।
১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারী, পূর্ব পাকিস্তানের ৮ টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ৮ দফা দাবী সংবলিত একটি প্রস্তাব প্রদান করে। তাদের ৮ দফা দাবিগুলোর অন্যতম কয়েকটি ছিল যথাক্রমে, ফেডারেল ব্যবস্থায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, সার্বজনীন ভোটাধিকারে ভিত্তিতে নির্বাচন, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, এবং সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি।
গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী, পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল করে। মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। একটি গুলি এসে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামানের শরীরে।
শহিদ আসাদের মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন ছাত্র পরিষদ হরতাল ও ধর্মঘটের ডাক দেয়। তাঁর মৃত্যুতে ২১ শে জানুয়ারী সারা দেশে শোক দিবস পালিত হয় এবং ২৩ তারিখ মশাল মিছিল কর্মসূচী পালন করা হয়।
দেশব্যাপী এমন অবস্থা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য সন্ধ্যা আইন জারি করে। ফলে দেশব্যাপী একটি ভয়াবহ অবস্থার তৈরি হয়।
১৯৬৯ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারী, পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য এবং পারস্পরিক আলোচনার জন্য আইয়ুব খান ঢাকা সফর করেন। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকার সর্বত্রই ‘‘আইয়ুব ফিরে যাও’’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে যায়। সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্থানে কালো পতাকা উত্তেলিত হয়।
আলোচনার কোন সাড়া না পেয়ে আইয়ুব খান ১২ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারী ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির আহবানে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হরতাল পালিত হয়। যার ফলে আইয়ুব খান ক্রমে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী, ঢাকার সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সামরিক সরকারের এমন আচরণে দেশব্যাপী জনতা আরো বেপরোয়া হতে থাকে। জনতার এই তীব্র আন্দোলন সারা দেশে বিস্তার লাভ করে।
১৮ই ফেব্রুয়ারী, প্রতিবাদ আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশ রাজশাহী বিম্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জোহানকে গুলি করে হত্যা করে। জনতা সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে রাস্তায় বিক্ষোভ করে।
অবশেষে, ২২ই ফেব্রুয়ারী, আইয়ুব খান জনতার বিক্ষোভের মুখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ বাকি বন্দিদের মুক্তি করে দেয়। ২৫ মার্চ, ১৯৬৯, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়ার নিকট পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়ুব খান।