চাকমা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। তারা মূলত নিজেদেরকে ‘চাঙমা’ বলে পরিচয় দেয়। বিশেষ করে তারা পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, এবং চট্টগ্রামে বাস করে। তবে চাকমারা প্রধানত খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান জেলায় অধিক দেখা যায়। এছাড়াও ভারতে বিশেষ করে অরুণাচল, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যেও চাকমা বাস করে। বর্তমানে প্রায় ৭ লক্ষ্যের অধিক চাকমা আদিবাসী রয়েছ।
চাকমা মৌখিক ইতিহাস অনুসারে, চাকমা উপজাতিটি ত্রিপুরার চম্পকনগর থেকে বার্মার পশ্চিমাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চল আরাকানে চলে আসে। যেখানে তারা প্রায় ১০০ বছর ধরে বাস করছিল। ষোড়শ শতকের দিকে, তারা উত্তর দিক দিয়ে বাংলাদেশে ডুকে পড়ে এবং বাংলার শাসক নবাব তাদেরকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়।
ব্রিটিশরা চাকমা উপজাতির সাথে হস্তক্ষেপ বিহীন নীতি অনুসরণ করেছিল কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে বিরাজমান অস্থিরতায় অবশেষে চাকমা অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য করে। এমতাবস্থায় কোম্পনী পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনের জন্য বিভিন্ন বিধি-বিধান আরোপ করে।
চাকমাদের নিজস্ব ভাষা , সংস্কৃতি, এবং লোককাহিনী রয়েছে। তারা ধর্মীয় দিক থেকে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। প্রাচীন প্রথার সাথে তাল মিলিয়ে চাকমা মহিলারা কোমরের চারপাশে একটি গোড়ালি দৈর্ঘ্যের কাপড় পরে যা কোমরের চারপাশে আবৃত থাকে। কোমরে জড়িত কাপড় ‘পিনোন’ নামে পরিচিত। চাকমারা হাতে বোনা বিভিন্ন জটিল ডিজাইন সমৃদ্ধ কাপড় পরতে পছন্দ করে।
চাকমা ভাষা অন্যন্য উপজাতি গোষ্ঠীগুলির থেকে পৃথক । চাকমারা তাদের নিজস্ব ভাষার সাথে সাথে বাংলা ভাষায়ও কথা বলতে পারে এবং অনেকেই বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় দক্ষ হয়ে থাকেন।
চাকমা সম্প্রদায় প্রত্যেক বছর বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। তাদের উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে বুদ্ধ পূর্ণিমা। এটি বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সময় যেমন, তাঁর জন্ম, অর্জন এবং তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পালিত হয়।
প্রতিবছর বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার দিনে এটি পালন করা হয়। উৎসবের দিনগুলিতে চাকমারা জাঁকজমক পোশাক পরে মন্দিরে যায়। সেখানে তারা গৌতম বুদ্ধের প্রতিমায় ফুল, এবং মোমবাতি প্রজ্বলিত করে। সবশেষে পুরোহিতদের কাছ থেকে বুদ্ধের বাণী শুনেন।
চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে বিজু উৎসব। বাংলা নববর্ষের সাথে মিলিয়ে তারা বিজু পালন করে। অনুষ্ঠানটি ৩ ভাগে পালিত হয়। চৈত্রের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখ মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
চাকমাদের তিন দিনের উৎসবটি অনেক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে উদযাপিত হয়। এই দিনগুলোতে চাকমাদের ঘরগুলি ফুল দিয়ে সজ্জিত করে। ছোট ছোট বাচ্চারা বয়স্কদের কাছ থেকে আশীর্বাদ অর্জনে বিশেষ নজর দেয়। অতিথিদের জন্য ভালো ভালো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়। বিজুর সময় রাঙ্গুনিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় মহামুনি মেলা, যেখানে সমস্ত পার্বত্য উপজাতির লোকদের মিলনমেলা হয়।
ঘরবাড়ি
ঐতিহ্য অনুযায়ী চকমারা বাঁশ দিয়ে বাড়ি তৈরি করে থাকে। এটি মাটির উপর থেকে প্রায় ৬ ফুট উচ্চতায় কাঠের মাচার উপর নির্মিত হয়। উপরে উঠার জন্য একটি কাঠের সিঁড়ি থাকে।
খাদ্য
চাকমাদের প্রধান খাদ্য হলো চাল, ভুট্টা, শাকসবজি এবং সরিষা। শাকসবজির মধ্যে কুমড়ো, তরমুজ এবং শসা অন্যতম। তারা মাছ, মুরগি, মাংস এমনকি শুয়োরের মাংসও খায়। বেশিরভাগ পার্বত্য উপজাতির মতো চাকমারাও দুধকে অপছন্দের সাথে দেখে। চাকমারা কঠিন মদ্যপানকারী হিসেবে বিখ্যাত, বিশেষ করে সামাজিক অনুষ্ঠানে অবাধে মদ খাওয়া তাদের এক প্রকারের ঐতিহ্য।
বিয়ে
চাকমারা প্রায় ১৫০ টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত, যা আরো অনেকগুলো উপগোষ্ঠীতে বিন্যস্ত। চাকমাদের একই সাবক্লান বা উপগোষ্ঠী সদস্যদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। যদিও এটি সবসময় কঠোরভাবে পালন করা হয় না। বয়স্ক বিবাহ চাকমা সমাজে আদর্শ হিসেবে দেখা হয়। পরিবারে পিতা-মাতাই বিবাহের ব্যবস্থা করেন। যদিও বিশেষ সময়ে পুত্র-কন্যার ইচ্ছা অনিচ্ছা বিবেচনা করা হয়।
চাকমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান ‘‘চুমুলং’’ নামে পরিচিত। বিয়ে বৌদ্ধ পুরোহিত দ্বারা সম্পাদন করা হয়।। চাকমাদের বহুবিবাহ, অর্থাৎ একাধিক স্ত্রীর সাথে বিবাহ স্বীকার্য রয়েছে, তবে এটি সচরাচর হয় না। তাদের বিধবা বিবাহের মতো বিবাহ বিচ্ছেদেরও অনুমতি রয়েছে।
আরো পড়ুন, গারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
চাকমা সংগ্রাম
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় রাজনৈতিক শক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে চলে গেলে ব্রিটিশরা চাকমা অঞ্চলকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট করে এবং চাকমা রাজার কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক ধার্য করা ‘করের’ পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে এক পর্যায়ে চাকমা রাজা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অতপর ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জানবক্স খান এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসিত হয়।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের উপজাতিদের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘‘শান্তি বাহিনী’’ গঠন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সামরিক শাখার নাম ছিল এই শান্তি বাহিনী। এই সংগঠন বহু বছর ধরে তাদের নায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টোগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান শন্তু লারমার সাথে একটি চুক্তিতে পৌছান।