হিটলার কে?

এডলফ হিটলার ইতিহাসের একজন মহানায়ক অথবা কারো কাছে খলনায়ক। তাঁর বর্জকণ্ঠ এবং কঠিন নেতৃত্বের জন্য তিনি আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে নাৎসি আন্দোলনের প্রবক্তা, জার্মানির ফ্রেসিডেন্ট, এবং চ্যান্সেলর। তাঁর একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসন ও ইহুদি বিদ্ধেষের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
হিটলারের প্রারম্ভিক জীবন
এডলফ হিটলার ২০ এপ্রিল, ১৮৮৯ সালে, অস্ট্রিয়ায় ব্রুনাও নামে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এলোইস হিটলার এবং মায়ের নাম শিকলগুবার। হিটলারের পিতা সামান্য বেতনে সরকারের রাষ্ট্রীয় শুল্ক বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর বাবার তিনজন স্ত্রী ছিল। হিটলার ছিল তার বাবার তৃতীয় স্ত্রীর তৃতীয় সন্তান। ১৯০৩ সালে এলোইস হিটলার মারা যান। কয়েকবছর পর অনেক দু:খ কষ্টের মধ্যে তাঁর মাতাও মৃত্যুবরণ করে।
অসচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় তিনি পড়ালেখা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেননি। মাধ্যমিক শিক্ষার আগেই জীবিকার জন্য পড়ালেখা ছাড়তে বাধ্য করে। ছোট বেলা থেকে হিটলার একগুয়ে, জেদি হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। পড়ালেখায় তেমন ভালো ছাত্র না হলেও তিনি ছবি আঁকায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন।
টাকার অভাবে স্কুল ছেড়ে দিয়ে তিনি একটি আর্ট স্কুলে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেন। এর জন্য তিনি দু দুবার ভিয়েনায় ফাইন আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে একটি বেসরকারি আর্টস স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর টাকার অভাবে সেটাও ছেড়ে দিতে হয়।
অবেশেষে, হিটলার ভাগ্য অন্বষণে বেরিয়ে পড়েন। কখনো মজুরের কাজ কখনো রং এর কাজ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করত। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থাকা অবস্থায় তিনি ইহুদি বিদ্বেষ এবং সাম্যবাদ বিরোধী মনোভাব পোষণ করা শুরু করেন।
১৯১৩ সালে হিটলার জার্মানির মিউনিখে চলে আসেন। পরের বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, তিনি সৈনিক হিসেবে জার্মান বাহিনীতে যোগ দেন। প্রায় আট সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর, তাকে অক্টোবর ১৯১৪ সালে, বেলজিয়ামে পাঠানো হয়। তিনি বেলজিয়ামের ইয়েপ্রেস যুদ্ধে প্রথম অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষ সময়ে তিনি আহত হন।
এই যুদ্ধে হিটলার অসম বীরত্বের এবং সাহসিকতার পরিচয় দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় তাঁকে বিষণ পীড়া দিত। যুদ্ধে হারের পর, জার্মানির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে চরম বিশৃংখলা দেখা দেয়। তখন জার্মানির অধিকাংশ শিল্প ব্যাণিজ্য ইহুদিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।
রাজনৈতিক উত্থান
 
মে ১৯১৯ সালে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন। এজন্য তিনি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জার্মান ওয়ার্কাস দলে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে, তিনি দলের প্রচার সম্পাদক পদে পদোন্নতি করেন। তাই, তিনি সেনাবাহিনীর এজেন্ট পদ থেকে সরে দাড়ান।
মাত্র ১ বছরের মধ্যে, তিনি তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের কারণে জার্মান ওয়ার্কাস দলের দলীয় প্রধান হয়ে যান। সেই সাথে দলের নাম দেন ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি। পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হয় নাৎসি পার্টি।
হিটলারের নতুন রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রপাগান্ডা থাকতো মূলত ইহুদি বিদ্বেষ। তিনি তাঁর জনসভায় ধনতন্ত্র, ইহুদি বিদ্ধেষ, এবং ভার্সাই সন্ধির অপমানজনক শর্তাবলীর তীব্র নিন্দা করতেন। এছাড়া ভাইমারের সাধারণতন্ত্রের বিপক্ষে জার্মানিদের ক্ষিপ্ত করে তুলতেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে, তিনি জার্মানির সব বয়সের লোকদের ন্যাশনাল ওয়ার্কাস পার্টিতে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। দলে দলে মানুষ তাঁর রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে শুরু করে।
এর মধ্যে অনেকেই নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন, জেলা সেনা কমান্ডার আর্নস্ট রাহম। হিটলারের আগে আর্নস্ট রাহম জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দিয়েছিল এবং  তিনি পার্টির মধ্যে হিটলারের উত্থানকে আরও এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়ও হিটলারের দলীয় সভা রক্ষা করতে, সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্টদের আক্রমণ করতে সেনাসদস্য ব্যবহার করতেন। হিটলারের ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব এবং গতিশীল নেতৃত্বের কারণে তিনি নাৎসি নেতাদের আকৃষ্ট করেছিলেন।
১৯২৩ সালে, হিটলার লুডেনডর্ফের সহযোগিতায় বলপূর্বক জার্মানির ক্ষমতা হস্তগত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন, এবং রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য বিচারের মুখোমুখি হয়ে পাঁচ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। তবে, তাঁকে মাত্র নয় মাস ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

হিটলারের আত্মজীবনীমূলক বই

ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে বন্দি অবস্থায়, হিটলার মেইন ক্যাম্প (Mcin Kampf) নামক রাজনৈতিক আত্মজীবনী লিখেন। তাঁর এই আত্মজীবনী ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মেইন ক্যাম্প গ্রন্থে হিটলার সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংসদীয় সরকারের রীতি নীতির তীব্র নিন্দা করেন। তিনি সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষের একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে জার্মান গণতন্ত্রের কথা ব্যক্ত করেন।
আত্মজীবনীমূলক বইটিতে তিনি জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্প্রসারণের একটি ভবিষ্যত কর্মসূচির পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তাঁর মতে, ”If we speak today of new territory in Europe, we can primarily think only the Russian and border states”
তিনি জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্প্রসারণের জন্য পূর্ব ইউরোপকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে মনে করেন। এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর প্রধান শ্লোগান ছিল ”Drive to East” অর্থাৎ পূর্ব দিকে চলো। মেইন ক্যাম্প গ্রন্থে, তিনি ফরাসিদের প্রতি তাঁর প্রচন্ড ঘৃণা ও বিদ্ধেষ লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, ”Franch is the eternal and mortal enemy of the German nation”। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং হিটলারের ভাবমূর্তি অনেকাংশে বেড়ে যায়।

হিটলারের শাসন

জেল থেকে মুক্তি পেয়ে, তিনি আবারও রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন। তাঁর তীর্যকঠিন বক্তব্য এবং উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হয়ে লোকজন নাৎসি দলে যোগ দিতে শুরু করে। নাৎসি পার্টির প্রতিক হিসেবে স্বোয়াস্তিকা গৃহীত হয়। হিটলারের নেতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে জার্মানির জনগণ বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক শ্রেণী যোগ দিতে শুরু করে হিটলারের  নাৎসি আন্দোলন ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে জার্মানরা তাদের মুক্তির পথ দেখতে পায়।
১৯২৫ সালে, নাৎসি দলকে পুনর্গঠিত করে শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। পরের বছর, ভাইমার শহরে নাৎসি দলের এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বপ্রথম ১৯২৮ সালের নির্বাচনে নাৎসি দল নির্বাচিত হয়ে রাইখস্ট্যাগে প্রবেশ করে।
নাৎসি পার্টি ১৯২৮ সালে, জাতীয় নির্বাচনে ২.৬ শতাংশ ভোট থেকে ১৯৩০ সালের নির্বাচনে ১৮ শতাংশ ভোট নিয়ে জার্মানীর দ্বিতীয় প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোট পাওয়ার পরও নাৎসি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি।আইনসভায় ৬০৮ টি আসনের মধ্যে তাঁর দলের আসন ছিল ২৩০ টি। ফ্রেসিডেন্ট হিণ্ডেনবার্গ হিটলারকে রাইখস্ট্যাগের চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রি পদে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন।
হিটলার জার্মানির সর্বময় কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে একটি আইন পাশ করেন। ফলে তিনি জার্মানির সর্বেসর্বা হয়ে পড়েন এবং সাধারণতন্ত্র বিলুপ্ত করে একনায়কতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৩৪ সালে, রাষ্ট্রপতি হিণ্ডেনবার্গ মারা গেলে, হিটলার জার্মানির ফুয়েরার বা সর্বপ্রধান বলে ঘোষনা করেন। তিনি একাধারে প্রেসিডেন্ট এবং চ্যান্সেলর পদ গ্রহণ করেন।

Similar Posts