বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস হল চাকরি প্রত্যাশিদের একটি স্বপ্নের ঠিকানা। প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর প্রথম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে বিসিএস দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু এটিতে সাফল্য পেতে শিক্ষার্থীদের একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং অত্যন্ত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়।
বিসিএস হল বাংলাদেশ কর্ম কমিশন কর্তৃক অনুষ্ঠিত পরিক্ষা, যা কমপক্ষে একজন স্নাতক ডিগ্রী বা তাঁর সমমান ডিগ্রি সম্পন্ন ২১-৩০ বছর বয়সি শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারে।বিসিএস পরীক্ষা তিন ধাপের একটি প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে পরীক্ষার্থীদের খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচায়-বাছায় করা হয়।
পরীক্ষাটি প্রতিবছর সমগ্র দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এই পরিক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে তিনটি মূল পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। এতে প্রায় দুই বছরের মত সময় লেগে যায়।
বিসিএস পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হলে আপনাকে কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রী বা তাঁর সমমান ডিগ্রি পাস হতে হবে, এবং আপনার বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে হওয়া লাগবে। বিসিএস পরিক্ষার তিনটি মৌলিক ধাপ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল।
1. বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ( BCS Priliminary Exam)
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে মূলত বিসিএস পরিক্ষা শুরু হয়। এই পরিক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মৌলিক বিষয়ের ঘাটতি পরীক্ষা করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের ছাটাই করা হয়। সম্পূর্ণরূপে বহুনির্বাচনী ভিত্তিক প্রিলিমিনারি পরিক্ষা, যা সাধারণত বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি, সাধারণ জ্ঞান, নীতিশাস্ত্র এবং শাসন এবং ভৌগলিক বিষয়ে আপনার দক্ষতা পরীক্ষা করে। প্রিলিতে মোট ২০০ নাম্বারের প্রশ্ন দেওয়া থাকে। মোটামুটি ২০০ নাম্বারের মধ্যে ১২০ পেলে প্রিলিতে উত্তীন্ন হওয়া যায়।
2. বিসিএস লিখিত পরীক্ষা (BCS Written Exam)
প্রথম ধাপের প্রিলিমিনারি পরিক্ষায় পাসকৃত শিক্ষার্থীরা লিখিত পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। বিসিএস পরিক্ষায় লিখিত অংশটি একটু বেশি কঠিন। এতে সাধারণ ক্যাডারে নয়টি বাধ্যতামূলক বিষয় যেমন, বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলাদেশ বিষয়াবলী, গণিত, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, সাধারণ বিজ্ঞান, মানসিক দক্ষতা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিতীয় পার্ট থাকে। প্রতিটি বিষয় ১০০ করে সর্বমোট ৯০০ নম্বরের পরিক্ষা হবে।
সাধারণ ক্যাডরের পরিবর্তে কারিগরি ক্যাডারের চাকরির জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি দুটি বাংলা বিষয়ের পরিবর্তে একটি দিবে। এছাড়া তাদের জন্য সাধারণ বিজ্ঞান বাদ দেওয়া হবে। এর পরিবর্তে কারিগরি পদে আবেদনকারী ব্যক্তি তার প্রাসঙ্গিক দুটি অতিরিক্ত বিষয়ের পরিক্ষা দিতে হবে।
প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরিক্ষায় কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা শেষ ধাপের ভাইভা পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে অধিকাংশ পরিক্ষার্থী বিসিএসের প্রথম দুই ধাপ অতিক্রম করতে পারে না। আর যারা পাস করে, তাদের জন্য ভাইভা হল চূড়ান্ত পর্যায়। এতে মোট ২০০ নাম্বারের পরিক্ষা হয়।
বিসিএস পরীক্ষা প্রক্রিয়ার একদম চূড়ান্ত পর্যায় হল বিসিএস সাক্ষাৎকার বা ভাইভা। আপনার জ্ঞানের পরিধি, কূটনৈতিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, উপস্থিত বুদ্ধি, এবং চাপের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি গুণাবলীর উপর আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে।
১. নিজেকে প্রস্তুত করুন (Be Ready Yourself)
বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করার পূর্বে নিজেকে এই দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা উচিত। প্রস্তুতি শুরু করার আগে অবশ্যই পরীক্ষার জন্য মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। নিজের লক্ষ্যসমূহ প্রতিষ্ঠা করুন এবং দক্ষতার সাথে সময় ব্যয় করুন। বিসিএস পরীক্ষার পুরো প্যাটার্ন বুঝে সেই অনুযায়ী বিসিএস প্রস্তুতি নিন।
২. বিসিএস সিলেবাস জানুন (Know BCS Syllabus)
সিলেবাসকে বলা হয় একটি পরীক্ষার প্রাণ। কারণ বই পড়ার আগে সিলেবাস সম্পর্কে জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিসিএস প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুসরণ করা অতি প্রয়োজন। প্রার্থীদের বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাস জানতে হবে এবং সেটা অনুসরণ করতে হবে। সিলেবাস জানলে প্রস্তুতি নিতে অনেকটায় সহায়ক হবে।
৩. টাইম টেবিল তৈরি করুন (Make a Time Table)
বিসিএস পরিক্ষার জন্য একটি সুসংগঠিত দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করা প্রয়োজন। প্রস্তুতির আগে আপনাকে একটি সময়সূচী নির্ধারণ করে সবসময় এটিকে মেনে চলা উচিত।
একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী তৈরি করে প্রস্তুতি নিলে বিসিএস একদম সহজতর এবং সুশৃঙ্খল করে তুলবে। এছাড়া সময়সীমার মধ্যে সিলেবাস দ্রুত শেষ করবেন।
৪. সংবাদপত্র/কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়া (Reading Newspaper or Current affairs)
দৈনন্দিন বিভিন্ন ঘটনাবলী জানা বিসিএস পরীক্ষার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিক। আপনি যদি দৈনিক সংবাদপত্র না পড়েন, তবে আপনি এই পরীক্ষায় ভালো করার আশা করতে পারবেন না। অতএব, দৈনিক সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিক খবরের সাথে লেগে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
৫. বোর্ড বই পড়ুন (Reading NCTB books)
ক্লাস ফাইভ থেকে বারো পর্যন্ত এনসিটিবির অনুমদিত বইগেুলো বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। NCTB এর পাঠ্যপুস্তক থেকে মৌলিক ধারণা এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব পেতে পারেন। বিগত বছরগুলোতে বিসিএস সরাসরি এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রশ্ন করেছে। তাই আপনার বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করার জন্য নিসন্দেহে এনসিটিবি বই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
৬. নোট তৈরি (Making Notes)
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন বিষয়ের সংক্ষিপ্ত নোট তৈরি করা প্রয়োজন। কারণ বিসিএসের সিলেবাস একটি বিস্তৃত বিষয়। আলাদা আলাদা বিষয়ের জন্য আপনাকে আলাদা নোটবুক করতে হবে। তাহলে পরিক্ষার সময় প্রস্তুতি নিতে একদম সহজ মনে হবে।
৭. উত্তর লেখার অভ্যাস করুন (Habit of writing answering )
বিসিএস লিখিত প্রশ্নপত্র বর্ণনামূলক প্রকৃতির। এর মাধ্যমে আপনার বিশ্লেষণাত্মক, সমালোচনামূলক এবং যোগাযোগের দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া আপনার ধারণাগত স্বচ্ছতার সাথে বিশ্বাস করার এবং দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি এবং ধারণাগুলিকে একটি নিখুঁত উপায়ে সংগঠিত করার দক্ষতা যাচাই করা হবে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত লেখার প্রশিক্ষণ ছাড়া এটি কখনোই সম্ভব হবে না।
৮. বিগত বছরের বিসিএস প্রশ্ন বিশ্লেষণ (Previous BCS exam’s questions analysis)
বিসিএস প্যাটার্ন এবং প্রশ্নের ধরনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হবে পূর্ববর্তী প্রশ্নপত্র। এর মাধ্যমে আপনি বিসিএস পরীক্ষার ধরণ সম্পর্কে জানতে ভূমিকা রাখবে। এটি আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে যে, কোন বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন।
৯. রিভিশন (Do Revision)
আপনি যখন বিসিএস পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছেন, তখন রিভিশন দেওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বিসিএস সিলেবাসটি অনেক বড়, ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যময়। এরজন্যে বারবার রিভিশন দিয়ে নিজেকে জ্বালাই করে নিবেন। এতে আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে।
১০. বিসিএস ইন্টারভিউ (BCS Interview)
বিসিএস পরীক্ষা প্রক্রিয়ার একদম চূড়ান্ত পর্যায় হল বিসিএস সাক্ষাৎকার বা ভাইভা। আপনার জ্ঞানের পরিধি, কূটনৈতিক দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, উপস্থিত বুদ্ধি, এবং চাপের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি গুণাবলীর উপর আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে।
আপনার আগ্রহ, শখ, পড়াশোনা এবং কাজের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়েও আপনাকে প্রশ্ন করা হবে। সুতরাং, আপনাকে এই দিকগুলির উপরও বিশেষ নজর রাখতে হবে। এছাড়া
নীতি, শাসন, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর নজর দিবেন।
১১. ইতিবাচক থাকুন (Be Positive)
পুরো বিসিএস ভ্রমণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ইতিবাচক থাকা। আপনার মাথা থেকে নেতিবাচক চিন্তা দূর করুন এবং কাজ করুন। অনেক কঠিন সময়েও স্থীর থাকতে হবে। হতাশা, ব্যর্থতা ইত্যাদিকে দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।