কনফুসিয়াস এর জীবনী

কনফুসিয়াস কে?

কনফুসিয়াস ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী চীনা দার্শনিক, শিক্ষক, এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কনফুসিয়ানিজমের দর্শনে তাঁর চিন্তাধারা আজকের দিন পর্যন্ত চীনা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। তার দর্শন তত্ত্ব পুণ্যময় জীবন, ধার্মিকতা এবং পূর্বপুরুষের উপাসনা গুরুত্ব লাভ করে।
এছাড়া জন হিতৈষী ও মিতব্যয়ী শাসকদের প্রয়োজনীয়তা। অভ্যন্তরীণ নৈতিক সম্প্রীতির গুরুত্ব এবং শারীরিক জগতে সম্প্রীতির সাথে এর সংযোগ। শাসক এবং শিক্ষকরা বৃহত্তর সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রোল মডেল ইত্যাদি কনফুসিয়াসের দার্শনিক ধারণা। কনফুসিয়াস, কং কিউ বা কুং ফু তু নামেও অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন চীনা দার্শনিক, শিক্ষক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
কনফুসিয়াস সম্ভবত ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের শানডং প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর  শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় নি। তবে, সুস-মা চিয়েন এর লেখায় কনফুসিয়াসের জীবনের সবচেয়ে বেশি বিবরণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক রেকর্ড মতে, কনফুসিয়াস চৌ রাজবংশের একটি রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চীনের মতাদর্শিক সংকটের সময়েও তাঁর অস্তিত্ব ছিল বলে সবাই বিশ্বাস করে।

কনফুসিয়াস দর্শন

তাঁর প্রচলিত দর্শন কনফুসিয়ানিজম হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে কনফুসিয়াস এবং তাঁর অনুগামীদের দ্বারা শেখানো রাজনীতি, শিক্ষা এবং নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে বিশ্বদর্শন হল কনফুসিয়ানিজম। কনফুসিয়ানিজম কোন সংগঠিত ধর্ম নয়। এটি চিন্তাভাবনা এবং জীবনযাপনের সুশৃংখল নিয়ম প্রদান করে। এছাড়া মানবতার প্রতি ভালবাসা, পূর্বপুরুষদের পূজা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্ম-শৃঙ্খলা এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সামঞ্জস্য করে।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে কনফুসিয়াসকে একজন মহাজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে, চীনের প্রথম হান রাজবংশের সময় তাঁর দর্শনগুলো রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তি হয়ে ওঠে। আজ কনফুসিয়াসকে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষকদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর দর্শনসমূহ আজও চীনের জনগণ অনুসরণ করে। তাছাড়া, জাপান, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামেও কনফুসিয়াসের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।
কনফুসিয়াসের বিশ্বাস, দর্শন এবং শিক্ষা
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, প্রতিযোগিতামূলক চীনা রাজ্যসমূহ চৌ সাম্রাজ্যের পতনসাধনের চেষ্টা করেছিল, যারা ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনে সর্বোচ্চ শাসন করেছিল। সেসময় চিরাচরিত চীনা নীতির অবনতি ঘটতে শুরু করে, ফলে নৈতিক অধ পতন ঘটে। কনফুসিয়াস তখন সহানুভূতি এবং সামাজিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করার একটি সুযোগ পান। তিনি তখন তাঁর বিশ্বাস, দর্শন, এবং শিক্ষার মাধ্যমে চীনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেন।
The Golden Rule: কনফুসিয়াসের সামাজিক দর্শন মূলত  ‘‘অন্যকে ভালবাসার’’ নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ‘‘আপনি নিজের জন্য যা চান না, অন্যদের জন্য তা করবেন না।’’
রাজনীতি দর্শন: কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শন একইভাবে স্ব-শৃঙ্খলার ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন নেতার আচরণ হবে নম্র এবং তার অনুসারীদের প্রতি সহানুভূতির সাথে আচরণ করা। এটি করার করার জন্য নেতারা ইতিবাচক উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দেবেন। কনফুসিয়াসের মতে, নেতারা তাদের অনুগামীদের আইন অনুসারে পুণ্য এবং অনুশীলনের উপযুক্ততা শেখানোর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করবে।
শিক্ষা দর্শন: কনফুসিয়াসের শিক্ষার দর্শন ‘‘সিক্স আর্টস’’ এর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। যেমন তীরন্দাজি, ক্যালিগ্রাফি, গণনা, সঙ্গীত, রথ-চালনা এবং শাস্ত্রিয় আচার পালন। কনফুসিয়াসের কাছে একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সততার সাথে বাঁচতে শেখানো। তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে, তিনি চীনা সমাজে ঐতিহ্যগত, অনুগত এবং আচারের মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

কনফুসিয়াস গ্রন্থ

Analects of Confucius: কনফুসিয়াস উপাখ্যান হচ্ছে একটি প্রাচীন চীনা গ্রন্থ, যা চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস এবং তাঁর সমসাময়িকদের উক্তি এবং ধারণার একটি বিশাল সংগ্রহ। গ্রন্থটি কনফুসিয়াসের অনুগামীদের দ্বারা সংকলিত এবং লেখা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এটি যুদ্ধরত রাজ্যকাল সময়ে রচিত বলে মনে করা হয় এবং এটি মধ্য হান রাজবংশের সময় (২০৬ খ্রিস্টপূর্ব -২২০ খ্রিষ্টাব্দ) সময়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। হান রাজবংশে অ্যানালেক্টস কনফুসিয়ানিজমের কেন্দ্রীয় গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল।
অ্যানালেক্টস বইটি গত ২০০০ বছর ধরে চীনে সর্বাধিক পঠিত এবং অধ্যয়ন করা বইগুলোর মধ্যে একটি, যা আজও চীন এবং পূর্ব এশীয়দের চিন্তাধারা এবং মূল্যবোধের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। লুনু, কনফুসিয়াসের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের চারটি বই এর মধ্যে একটি। এটি চীনা দার্শনিক ঝু শি ১১৯০ সালে শিশু Sishu হিসাবে প্রকাশ করে। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। লুনু পরে ইংরেজিতে দ্য অ্যানালেক্টস অফ কনফুসিয়াস শিরোনামে অনুবাদ করা হয়েছিল।
কনফুসিয়াস ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের কুফুতে মারা যান। মৃত্যুর সময় কনফুসিয়াস নিশ্চিত ছিলেন যে, তার শিক্ষা, দর্শন চীনা সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে নি। যদিও পরে তাঁর শিক্ষা চীনের সরকারী সাম্রাজ্য দর্শনে পরিণত হবে।

Similar Posts