ফিদেল কাস্ত্রো | ফিদেল কাস্ত্রো কে ছিলেন?

ফিদেল কাস্ত্রো কে ছিলেন?

কিউবার কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। ১৯৫৯ সালে, ফুলজেনসিও বাতিস্তার সামরিক স্বৈরশাসনের পতনের নেতৃত্বে দিয়ে কিউবায় প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে কিউবা শাসন করেছিলেন। কাস্ত্রোর শাসন নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বর্ণবাদ বিলোপ এবং জনস্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে সফল হয়েছিল, কিন্তু তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কাস্ত্রো ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ সালে, ৯০ বছর বয়সে মারা যান।
১৯২৬ সালের ১৩ই  আগস্ট, পূর্ব কিউবার ছোট শহর বিরানে জন্মগ্রহণ করেন কিউবান বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। তার বাবা ছিলেন একজন স্প্যানিশ আখ চাষী, যিনি কিউবার স্বাধীনতা যুদ্ধের (১৮৯৫-১৮৯৮) সময় প্রথম এই দ্বীপে এসেছিলেন। কাস্ত্রো হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যায়ন করেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে দুর্নীতিবিরোধী অর্থোডক্স পার্টিতে যোগদান করেন এবং স্বৈরশাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ব্যর্থ হন।
১৯৫০ সালে, কাস্ত্রো হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। দুই বছর পর, তিনি কিউবার প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু বাতিস্তার ক্ষমতা দখল করার কারণে প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনটি আর হয়নি।
কিউবান বিপ্লব
 
জুলাই, ১৯৫৩ সাল, সান্টিয়াগো ডি কিউবার মনকাদা সেনা ব্যারাকে কাস্ত্রো প্রায় ১২০ জনকে নিয়ে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আক্রমণে ব্যর্থ হলে কাস্ত্রোকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তার অনেক লোককে হত্যা করা হয়। বাতিস্তা ছিলেন মার্কিন সমর্থিত শাসক। ১৯৫৫ সালে, সাধারণ ক্ষমা করার অংশ হিসেবে কাস্ত্রোকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়ে কাস্ত্রো মেক্সিকোতে সহকর্মী বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার সাথে দেখা করে কিউবায় প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করেন।
পরের বছর, কাস্ত্রো প্রায় ৮১ জনকে সাথে নিয়ে কিউবার পূর্ব উপকূলে পৌছান, কিন্তু বাতিস্তার সরকারী বাহিনী অবিলম্বে তাদের আক্রমণ করে। ফলে কাস্ত্রো তার ভাই রাউল এবং চে গুয়েভারা সহ আনুমানিক ১৯ জন দক্ষিণ -পূর্ব কিউবার সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতের গভীরে পালিয়ে যায়। এরপর তারা সেনাবাহিনীর ছোট ছোট ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে। ১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে, তারা রুরাল গার্ড টহলের বিরুদ্ধে ছোট ছোট যুদ্ধ জিততে শুরু করে।
১৯৫৮ সালে, বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টার অংশ হিসেবে বাতিস্তার বোমারু বিমান এবং নৌ -উপকূলীয় ইউনিটগুলিকে সাথে নিয়ে একটি বিশাল আক্রমণ করেন। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি, বিদ্রোহী গেরিলারা তাদের ভূমি ধরে রাখে এবং পাল্টা আক্রমণ চালায়। ফলস্বরুপ, তারা বাতিস্তার কাছ থেকে কিউবার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়। এক সপ্তাহ পরে, কাস্ত্রো হাভানায় এসে শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেইসাথে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে পূর্বের শাসক সদস্যদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে শুরু করেন।
কাস্ত্রোর শাসন
 
১৯৬০ সালে, ক্যাস্ট্রো কিউবার ক্ষমতা গ্রহনের পর, তেল শোধনাগার, কারখানা এবং ক্যাসিনো সহ সমস্ত মার্কিন মালিকানাধীন ব্যবসা জাতীয়করণ করেছিলেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে, সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং অর্থায়নে প্রায় ১৪০০ কিউবান নির্বাসিত লোক কাস্ত্রোকে উৎখাত করার অভিপ্রায় নিয়ে পিগস উপসাগরের অবস্থান করে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত, ১০০ এরও বেশি নির্বাসিত নিহত হয়েছিল এবং বাকিদের বন্দী করা হয়। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে, কাস্ত্রো বন্দিদের চিকিৎসা সামগ্রী এবং শিশু খাদ্যের ৫২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেন।
১৯৬১ সালের শেষের দিকে, কাস্ত্রো প্রকাশ্যে নিজেকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলে ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবার অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। ১৯৬০ সালে কিউবার ক্ষমতা গ্রহণের পর, কাস্ত্রো বিভিন্ন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন,
  • সকল প্রকার আইনি বৈষম্য দূর করেন।
  • প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেন।
  • বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নত করেন।
  • নতুন স্কুল ও চিকিৎসা সুবিধা তৈরি করেন।
কিন্তু তিনি বিরোধী সংবাদপত্র বন্ধ করে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে দমন করেন। ক্ষমতা বজায় রাখতে নতুন নির্বাচনের দিকে কোন পদক্ষেপ নেননি। অধিকন্তু, তিনি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ ও ব্যক্তিগত ব্যবসা বিলুপ্ত করেন। ফলে কিউবায় আবাসন ও নিত্যপন্যের অভাব দেখা দেয়। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত করার কারণে হাজার হাজার কিউবান পেশাদার এবং প্রযুক্তিবিদ কিউবা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাড়ি জমান।
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত, কাস্ত্রো লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন বামপন্থী গেরিলা আন্দোলনে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। ৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরও বিস্তৃত করা হয়। তবুও, তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিউবার এই বিপ্লবী নেতা ২০১৬ সালে ৯০ বছর বয়সে মারা যান।