বাংলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধ্যযুগের কাব্যে দেবদেবীর মাহাত্মসূচক কাহিনী থেকে বের হয়ে বাংলা কাব্যধারায় মানবতাবোধ সৃষ্টি পূর্বক আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য তৈরি ছিল তার অতুলনীয় কীর্তি। তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করে বাংলা কাব্য জগতে পরিবর্তন আনয়ন করেন। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। এছাড়া তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘মেঘনাধবধ কাব্যের রচয়িতা।
মধুসূদন ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি। কলকাতার হিন্দু কলেজে অধ্যায়ন অবস্থায় ১৮৪৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মাইকেল নামটি যোগ করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন একজন মহাকবি ও নাট্যকার। তিনি ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ সালে, যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে একটি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত। মধুসূদন প্রাথমিকভাবে তার মা জাহ্নবী দেবীর সাথে নিজ বাড়িতে এবং পরে সাগরদাঁড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে, তিনি কলকাতার খিদিরপুর স্কুলে ভর্তি হন, এবং যেখানে তিনি দুই বছর অধ্যয়ন করেন। ১৮৩৩ সালে, তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এখানে, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তিনি বাংলা, সংস্কৃত এবং ফারসি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন।
মধুসূদন হিন্দু কলেজে অধ্যায়ন অবস্থায় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ১৮৩৪ সালে, কলেজের একটি অনুষ্ঠানে, নিজের লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। হিন্দু কলেজে মধুসূদনের সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু। তিনি কলেজে বেশ কিছু বৃত্তি লাভের পাশাপাশি নারী শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধের জন্য স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।
১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, হিন্দু কলেজে অধ্যায়ন অবস্থায় মধুসূদন খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার পর ‘মাইকেল’ নামটি গ্রহণ করেছিলেন। যাইহোক, খ্রিস্টান হওয়ার পর, মধুসূদনকে হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কার হতে হয়, কারণ খ্রিস্টানদের সেখানে পড়ার অনুমতি ছিল না। ১৮৪৪ সালে, তিনি বিশপের কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সেখানেই থাকেন।
১৮৪৮ সালে মাইকেল মাদ্রাজ চলে যান এবং যেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রথমে মাদ্রাজ পুরুষ অরফান আশ্রয় স্কুলে এবং তারপর মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেচিলেন। শিক্ষকতা ছাড়াও মধুসূদন বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র এবং জার্নালের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ইউরেশিয়ান (পরে ইস্টার্ন গার্ডিয়ান), মাদ্রাজ সার্কুলেটর এবং জেনারেল ক্রনিকল এবং হিন্দু ক্রনিকল সম্পাদনা করেন। মাদ্রাজ থাকাকালীন, তিনি ‘টিমোথি পেনপোয়েম’ ছদ্মনামে ইংরেজি কবিতার দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যেমন, ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ ও ‘ভিশনস অব দ্য পাস্ট’।
মাদ্রাজে থাকাকালীন মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটাভিসকে বিয়ে করেন। এরই মধ্যে তার মা-বাবা মারা যায়। মধুসূদন তখন স্ত্রী রেবেকাকে ছেড়ে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে, হেনরিয়েটা নামে এক ফরাসি মহিলার সাথে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় আসার পর, তিনি প্রথমে পুলিশ আদালতে কেরানি এবং তারপর দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। তিনি তখন বিভিন্ন জার্নালেও লেখা প্রকাশ শুরু করেন। তার বন্ধুরা তাকে বাংলায় লেখার তাগিদ দেয়।
রামনারায়ণ তর্করত্নের নাটক রত্নাবলীর (১৮৫৮)) ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময়, তিনি বাংলায় ভালো নাটকের অনুপস্থিতি অনুভব করেন। ১৮৫৮ সালে, তিনি দেবায়নী ও ইয়াতির মহাভারত কাহিনী অবলম্বনে পাশ্চাত্য ধাঁচের নাটক শর্মিষ্ঠা রচনা করেন। এটি ছিল বাংলার প্রথম মৌলিক নাটক, যা মধুসূদনকে প্রথম বাংলা নাট্যকার বানিয়েছিল। পরের বছর, তিনি দুটি প্রহসন লিখেছিলেন। যথা: একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০) এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০)।
তাঁর প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যের শৈলী এবং বিষয়বস্তুতে স্থবিরতা দূর হয়েছিল। তিনিই প্রথম গ্রিক মিথ অবলম্বনে পদ্মাবতী নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের এই ব্যবহার বাংলা কবিতাকে ছন্দযুক্ত পদ্যের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করেছে। এই সাফল্য মধুসূদনকে অমিত্রাক্ষরে তিলোত্তমাসম্ভব লিখতে উৎসাহ প্রদান করেছিল। ১৮৬১ সালে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করে চারদিকে সাড়া পেলে দেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা মহাকাব্যটি রামায়ণের কাহিনী উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
১৮৬৩ সালে, তিনি ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে যান, সেখানে দুই বছর অবস্থান করেন। ফ্রান্সে থাকা অবস্থায়, তিনি পেট্রাক ছন্দে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। তাঁর এই সনেটগুলো ১৮৬৬ সালে চতুর্দশপদী কবিতা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। মধুসূদন ১৮৬৫ সালে ভার্সাই থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৮৬৬ সালে, তিনি ব্যারিস্টার হন। তিনি পরের বছর কলকাতায় ফিরে আসেন এবং আইন চর্চা শুরু করেন। যাইহোক, এত সব উত্থান -পতন সত্ত্বেও মধুসূদন লিখতে থাকলেন। তাঁর শেষ রচনা ছিল মায়াকানন, যা ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়।
মধুসূদনের শেষ দিনগুলো অসুস্থতা এবং চিকিৎসার অভাবে খুবই বেদনাদায়ক ছিল। তার নিজের কোন জায়গা ছিল না, যার ফলে, তাঁকে কলকাতার উত্তর পাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন , বাংলার নবজাগরণের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতা জেনারেল হাসপাতালে শোচনীয় অবস্থায় মারা যান।
মধুসূদন ছিলেন ১৯ শতকের বাংলার নতুন জাগরণের পথিকৃৎ। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার দ্বারা তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন ধারা সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন।