চর্যাপদ কি?
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নির্ভরযােগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদ হচ্ছে মূলত বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতাবলম্বী সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ রচিত কাব্য বা গানের সংকলন। এগুলো ছিল বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বকথা। এগুলোর মাধ্যমে পালযুগের সাধারণ বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় ফুটিয়ে উঠেছে। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন বলে বিবেচিত হওয়ায় প্রাচীন বাঙালির জীবন ও সাধনা সম্বন্ধে অনেক রহস্যের সমাধান ঘটেছে।
চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা ভাষার এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে প্রাচীন বাংলা ভাষা আধুনিককালের বাংলার মত এত সুগঠিত ছিল না। ফলে এটি পড়তে ও বুঝতে একটু সমস্যা হতেই পারে। এমন অপরিণত ভাষাতেই চর্যাপদের কবিগণ তাদের ধর্মতত্ত্ব প্রতিফলনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। চর্যাপদে কখনও প্রহেলিকা ভাষায়, কখনও দার্শনিক ভাষায়, কখনও যােগসাধনের পরিভাষায়, কখনওবা তান্ত্রিক কায়াসাধনের গুঢ় সঙ্কেতের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) গ্রন্থে চর্যাপদের ধ্বনিতত্ত্ব ব্যাকরণ ও ছন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, চর্যার পদসংকলনটি আদিতম বাংলা ভাষায় রচিত।
চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলায় হওয়ায় তখনকার ভাষার গৌড় অপভ্রংশের প্রভাব এতে রয়ে গেছে। ফলে কেউ কেউ চর্যাপদের ভাষাকে অপভ্রংশ, প্রাচীন হিন্দি, মৈথিলি, উড়িয়া বা আসামি ভাষা বলে দাবি করেন। চর্যাপদের কবিগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে সকলের ভাষা একরূপ হতে পারে নি।
চর্যাপদের রচনাকাল
চর্যাপদের কবিগণের মত এর রচনাকাল নিয়েও অনেক মতভেদ রয়েছে। এর পদসমূহের রচনার সময় এক না হওয়ায়, চর্যাপদের সঠিক রচনাকাল সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন নি। তবে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, চর্যাপদের কাল ৬৫০ সাল থেকে শুরু হয়েছে। তিনি চর্যার রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বলে মত দিয়েছেন। অপরদিকে, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৯৫০ সাল থেকে চর্যাপদের রচনাকাল বলে অনুমান করেন। কারণ হিসেবে তিনি ব্যক্ত করেন যে, চতুর্দশ শতকের শেষভাগে রচিত
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা অপেক্ষা চর্যার ভাষা দেড় শ বছরের প্রাচীন ছিল। তাঁর মতে চর্যার রচনাকাল ৯৫০ থেকে ১২০০ সাল।
কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, চর্যাপদের কবিগণের আবির্ভাব কাল সঠিকভাবে নির্ধারণের সুযােগ না থাকায়, অনেকটাই অনুমানের ওপর নির্ভর করে রচনাকাল চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। একারণে, গবেষকদের তথ্যের ব্যাপারেও সবাই একমত হতে পারেন নি।
চর্যাপদ আবিষ্কারের ইতিহাস
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত চর্যাপদগুলাে সম্পর্কে ১৯০৭ সালের আগে কোন তথ্যই জানা ছিল না। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত Sanskrit Buddhist Literature in Nepal গ্রন্থে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সর্বপ্রথম নেপালের বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। কৌতূহলে উদ্দীপ্ত হয়ে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তৃতীয় বার নেপাল সফর কালে নেপালের রাজগ্রন্থাগার ‘নেপাল রয়্যাল লাইব্রেরি’ থেকে ১৯০৭ সালে সাহিত্যের কতকগুলাে পদ আবিষ্কার করেন।
তাঁর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে সে সব পদ ১৯১৬ সালে ( বাংলা ১৩২৩) চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব-এ চারটি পুঁথি একত্রে ‘‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
চারটির মধ্যে একমাত্র চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ই প্রাচীন বাংলায় লেখা। অন্য তিনটি বাংলায় নয়, বরং অপভ্রংশ ভাষায় রচিত। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ১৯২৬ সালে এগুলাের ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রথম আলােচনা করেন। ১৯২৭ সালে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে প্রথম আলােচনা করেন। ১৯৩৮ সালে ড, প্রবােধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক চর্যার তিব্বতি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
টীকাকার মুনিদত্তের মতানুসারে চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিতে উল্লেখিত পদসংগ্রহের নাম ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’। নেপালে প্রাপ্ত পুঁথিতে পদগুলাের নাম দেওয়া হয়েছে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়। এ দুটি নাম মিলিয়ে ড. প্রবােধচন্দ্র বাগচী ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ নামের পরিকল্পনা করেন। সে আমলে শত শত চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মুনিদত্তের মত অনেকেই বিভিন্ন চর্যাগীতির টীকা রচনা করেছিলেন। কীর্তিচন্দ্র মুনিদত্তের টীকার তিব্বতি অনুবাদ করেছিলেন চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ নামে। এতে মনে হয় মূল সংকলনের নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ। আধুনিক পণ্ডিতগণের অনুমান যে পুঁথিটির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ এবং এর সংস্কৃত টীকার নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’।
চর্যাপদের পুঁথিটি যে-রূপে পাওয়া গেছে তাতে বােঝা যায়, এটি বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত বিভিন্ন কবির রচিত কবিতা-সমষ্টির সংকলন। কাব্যসমূহের প্রকাশভঙ্গিতে যে দুর্বোধ্যতা ছিল তা দূর করার জন্য মুনিদত্ত পদগুলােকে একত্রিত করে সংস্কৃত ভাষায় পদগুলাের সহজবােধ্য টীকা রচনা করেছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে মূল চর্যাপদ ও মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা যুক্ত করা হয়েছে। পুঁথিটি খণ্ডিত ছিল বলে টীকাকারের নাম পাওয়া যায় নি।
পরে ড. প্রবােধচন্দ্র বাগচী একই সংকলনের তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন এবং তাতে টীকাকার হিসেবে মুনিদত্তের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত পুঁথিটি মুনিদত্তের মূল সংকলন গ্রন্থ নয়, এটি ছিল অনুলিপি অথবা অনুলিপির অনুলিপি। চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার আদি স্তরের লক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে পালযুগের সাধারণ বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় এতে রূপলাভ করেছে। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন বলে বিবেচিত হওয়ায় প্রাচীন বাঙালির জীবন ও সাধনা সম্বন্ধে অনেক রহস্যের সমাধান ঘটেছে।
চর্যাপদ সদ্য নির্মীয়মান বাংলা ভাষার নিদর্শন। এর রচয়িতাগণ দুরূহ ধর্মতত্ত্বকে সহজবােধ্য রূপকে উপস্থাপন করেছেন। আর সেই সঙ্গে রেখেছেন কবিত্বশক্তির উজ্জ্বল স্বাক্ষর। চর্যার প্রাপ্ত পুঁথিতে ৫১ গান ছিল। তার মধ্যে একটি (১১ সংখ্যক) পদ টীকাকার কর্তৃক ব্যাখ্যা হয়নি। আবার পুঁথির কয়েকটি পাতা নষ্ট হওয়ায় তিনটি সম্পূর্ণ (২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক) পদ এবং একটি (২৩ সংখ্যক) পদের শেষাংশ পাওয়া যায় নি। তাই পুঁথিতে সর্বসমেত সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে।
চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিটির লিপিকাল বার থেকে ষােল শতকের মধ্যে বলে অনুমান করা হয়। তবে ১১৯৯ সালে লিপিকৃত ‘পঞ্চাকার’ নামের পুঁথির লিপির সঙ্গে চর্যাপদের লিপির সাদৃশ্য বিবেচনা করে কেউ কেউ এর লিপিকাল ১২ শতক বলে মনে করেন।
১৯০৭ সালে চর্যাপদ আবিষ্কারের পর থেকে অনেক পণ্ডিত ও গবেষক এ বিষয়ে আলােচনা করে এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলােকপাত করেছেন। চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নাম এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে স্মরণীয়। ১৯১৬ সালে চর্যাগীতি প্রকাশ করে তিনি একে বাংলা ভাষার প্রথম অবস্থার রচনা বলে যে ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন তা পরবর্তী কালের গবেষকগণ মেনে নিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে প্রকাশিত দুটি দোহাকোষ ও একটি ডাকার্ণব, যা বাংলায় রচনা ছিল না।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কারের কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘‘১৯০৭ সালে আবার নেপালে গিয়া আমি কয়েকখানি পুঁথি দেখিতে পাইলাম। একখানির নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, উহাতে কতকগুলি কীর্তনের গান আছে ও তাহার সংস্কৃত টীকা আছে। গানগুলি বৈষ্ণবদের কীর্তনের মত, গানের নাম চর্যাপদ।’’
তথ্যসূত্র
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম
The Origin and Development of the Bengali language- C. Suniti Kumar
বাংলা সাহিত্যের কথা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত- ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য- প্রবোধচন্দ্র বাগচী