আমেরিকার সংবিধান প্রণয়ন
৪ জুলাই, ১৭৭৬ সালে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন ইতিহাস শুরু হয়েছিল। নবগঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান প্রনয়নের লক্ষ্যে ১১ জুলাই, ১৭৭৬ তারিখে, জন ডিকেনসনের অধীনে একটি কমিটি গঠিত হয়, যারা কনফেডারেশনের সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিল। তবে, রাজ্যগুলোর কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পর, সংবিধানের বিভিন্ন ধারা নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে কলহ তৈরি হয়। এসব সমস্যা ও বিবাদ মীমাংসার জন্য সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজন দেখা দেয়।
সংবিধান সংশোধনের জন্য ফিলাডেলফিয়ায় একটি কনভেনশনের আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে ১২ টি রাজ্যের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। এক সপ্তাহের আলোচনার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সংবিধান সেখানে উপস্থিত রাজ্যের প্রতিনিধিদের দ্বারা ১৭৮৭ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর সর্বসম্মতিক্রমে স্বাক্ষরিত হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ১৭৮৮ সালের ২১ শে জুন সংশোধিত নতুন সংবিধানটি অনুমোদিত হয়েছিল। আমেরিকার বর্তমান সংবিধানটি তৈরিতে ম্যাডিসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
আমেরিকার সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
আমেরিকার সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো যথাক্রমে: লিখিত সংবিধান, কঠোর সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, চেক এবং ব্যালেন্স পদ্ধতি, , বিচারিক পর্যালোচনা, রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা, ফেডারেল সিস্টেম, প্রজাতন্ত্রের ব্যবস্থা, লুণ্ঠনের ব্যবস্থা, অধিকারের বিল, এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব।
১. লিখিত সংবিধান (Written Constitution)
আমেরিকান সংবিধান ১৭৮৭ সালে প্রণীত একটি লিখিত সংবিধান। সংবিধানটি সাতটি অনুচ্ছেদ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে তিনটি আইন কাঠামো ও ক্ষমতা সম্পর্কিত (অনুচ্ছেদ ১), নির্বাহী (অনুচ্ছেদ ২) এবং বিচার বিভাগ ( অনুচ্ছেদ ৩) এবং বাকি চারটি রাজ্য সম্পর্কিত (অনুচ্ছেদ ৪), সংশোধনের পদ্ধতি (অনুচ্ছেদ ৫), জাতীয় ক্ষমতার আধিপত্য (অনুচ্ছেদ ৬) এবং অনুমোদন (অনুচ্ছেদ ৭)। আমেরিকার সংবিধান হল সেই দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্যান্য সংবিধানের মতো এটিও একটি প্রস্তাবনা নিয়ে গঠিত
২. কঠোর সংবিধান (Rigid Constitution)
আমেরিকার সংবিধান বিশ্বের অন্যতম কঠোর সংবিধান, যার অর্থ এটি সংশোধন করার জন্য একটি বিশেষ এবং কঠিন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। মার্কিন সংবিধান সংশোধনের জন্য ২ টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। যেমন:
সংশোধনের জন্য প্রস্তাব
- আমেরিকার আইনসভার উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ (সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদ) সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দেবে বা দুই-তৃতীয়াংশ রাজ্যের আইনসভার প্রয়োগের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাবের জন্য একটি সম্মেলন আহ্বান করবে।
প্রস্তাব অনুমোদন
- সংশোধনী সকল রাজ্যের তিন চতুর্থাংশ আইনসভা বা তিন চতুর্থাংশ রাজ্যের সম্মেলন দ্বারা অনুমোদিত হবে। এই অনমনীয়তার কারণেই আমেরিকার সংবিধান ২০০ বছরেরও বেশি সময়ে মাত্র ২৭ বার সংশোধন করা হয়েছে।
৩. চেক এন্ড ব্যালেন্স (Checks & Balances)
চেক এন্ড ব্যালেন্স বা ক্ষমতার বিভাজন দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা হয়। মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতাগুলো এমনভাবে প্রদান করা হয় যে, এটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপর চেক বা ভেটো প্রদান করতে পারবে। যেমন: রাষ্ট্রপতি, আইনসভা, এবং বিচার বিভাগ। এসকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের কাজের ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
উদাহরণ:
- রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের পাস করা একটি বিলে ভেটো দিতে পারেন। কংগ্রেস দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রাষ্ট্রপতির সেই ভেটো বিষয়ে আইন পাস করতে পারে।
- রাষ্ট্রপতির সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রয়েছে।
- সংবিধান সুপ্রিম কোর্টে “জুডিশিয়াল রিভিউ” এর ক্ষমতা অর্পণ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত যেকোনো পদক্ষেপ বা কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনকে অনুমোদন, প্রত্যাখ্যান অথবা পর্যালোচনা করতে পারে।
এই পদ্ধতিগুলো সুস্থ গণতন্ত্রের একটি চিহ্ন বহন করে। এছাড়া এটি স্বৈরশাসকদের উত্থানকেও রোধ করে।
৪. দ্বিকক্ষ আইনসভা (Bicameral Legislature)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠন করার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১ অনুসারে, ‘সকল আইনী ক্ষমতা কংগ্রেসের উপর ন্যস্ত।’ কংগ্রেস নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদ এবং উচ্চকক্ষ বা সিনেট নিয়ে গঠিত।
নিম্মকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদ (House of Representatives)
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিম্মকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ৪৩৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। আমেরিকার রাজ্যগুলোর জনসংখ্যার অনুপাতে নিম্মকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হয়। সর্বোচ্চ ৫৩ জন সদস্য ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের। মাত্র একটি করে সদস্য রয়েছে এমন রাজ্যগুলো হচ্ছে আলাস্কা, মন্টানা, ডেল্যাওয়ার, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা, ভারমন্ট, এবং ওয়াইমিং রাজ্য। নিম্মকক্ষ চাইলে যেকোন বিলের ওপর ভেটো দিতে পারবে।
উচ্চ কক্ষ সিনেট (Senate)
- সিনেট সদস্যরা রাজ্যের আইনসভা দ্বারা নির্বাচিত হন। প্রতিটি রাজ্য থেকে দুইজন সিনেটর নিয়োগ দেয়া হয়, যাদের সেনেটে দুটি ভোট থাকে। এই সিনেটররা সমতার ভিত্তিতে ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন। মার্কিন রাজ্যের সংখ্যা ৫০ হওয়ায় সিনেটরদের সংখ্যা ১০০ জন।
৫. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ (Separation of Powers)
ক্ষমতা পৃথকীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সরকারের তিনটি স্তম্ভ/প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়। ক্ষমতাগুলো কংগ্রেস, রাষ্ট্রপতি এবং বিচার বিভাগের মধ্যে বিভক্ত থাকে।
কংগ্রেসের এমন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে যা সাধারণ নীতিমালার রূপরেখা দেয় এবং নির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রপতি আইন প্রয়োগ ও পরিচালনা করতে পারেন। তাকে তার মন্ত্রিসভা দ্বারা সাহায্য করা হয় কিন্তু নির্বাহী শাখার সকল কর্মের জন্য তিনি সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকে। বিচারিক ক্ষমতা সমূহ সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা প্রয়োগ করা হয়, যা আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিগুলো দ্বারা বিভিন্ন মামলা এবং বিতর্কের ব্যাখ্যা প্রধান করে।
৬. ফেডারেল সিস্টেম (Federal System)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে একটি ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার কথা বলা আছে, যার অর্থ হল কেন্দ্র বা ফেডারেল সরকার এবং রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত থাকবে। অনুচ্ছেদ ১ অনুসারে, ফেডারেল সরকারের ১৮ টি বিষয়ের এখতিয়ার রয়েছে এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা রাজ্যগুলোতে ন্যস্ত থাকবে। রাজ্যসমূহ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং কেন্দ্রগুলো তাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাজ্য বা প্রদেশের যেকোন দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট বিরোধ নিষ্পত্তি করবে।
৭. রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি (President System government)
সংবিধানে রাষ্ট্রপতির সরকার গঠনের বিধান রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রদান করে। একজন রাষ্ট্রপতি ৪ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন, যিনি কংগ্রেসের কাছে তার কৃত কাজের জবাবদিহি করেন না। আবার তিনিও কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি তার নির্বাহী ক্ষমতা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে।
৮. অধিকারের বিল (Bill of Rights)
মার্কিন সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনীকে বলা হয় ‘‘অধিকারের বিল’’। এটি ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্র, ধর্ম এবং সমাবেশের অধিকার প্রদান করে।
৯. দ্বৈত নাগরিকত্ব (Dual Citizenship)
সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্বের কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং যে রাজ্যে বাসস্থান করছে তার ওপর ভিত্তি করে দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভ করে। যেমন: কোন আমেরিকান নাগরিকের বাসস্থান নিউইয়র্ক রাজ্যে হলে, তখন তিনি একই সাথে সেই রাজ্যের নাগরিক এবং আমেরিকার।