ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস কী কী?

ব্রিটিশ সংবিধানের ইতিহাস

পৃথিবীর প্রাচীনতম সংবিধানের মধ্যে ব্রিটিশ বা ইংল্যান্ডের সংবিধান অন্যতম। সংবিধান হল একটি রাষ্ট্রের শাসন কার্য, বিচার ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিধিবদ্ধ দলিল। ”The Mother of all Constitution” নামে খ্যাত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সংবিধান ব্রিটিশ সংবিধান। এটি নানা বিবর্তন, পরিবর্তন ও শান্তিপূর্ণ ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌছেছে। ব্রিটিশ সংবিধানের এরুপ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ সামন্তবাদ, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র,  অভিজাততন্ত্র এবং গোষ্ঠীতন্ত্রের মধ্যদিয়ে আধুনিক গণতন্ত্রের স্বরুপে এসেছে।
ব্রিটিশ সংবিধান কোন একটি নির্দিষ্ট সূত্র থেকে উদ্ভূত হয় নি। এ কারণেই এটাকে কোন লিখিত ও বিধিবদ্ধ আকার দেয়া সম্ভব হয় নি। ইংল্যান্ডের প্রাচীন রীতি নীতি ও ঐতিহ্য সংবিধানের ব্যাপক অংশকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ব্রিটিশ সংবিধানে উল্লেখ করা হয় যে, “The United Kingdom… has no written constitution, no single document intended to comprise the fundamental rules of constitutional practice. Those fundamental rules are… enshrined in various Acts of Parliament, in the judicial decisions, in parliamentary law and custom and in… unwritten practices, usually known as conventions…”
অধ্যাপক মুনরাে (Munro) বলেছেন, “The British constitution is not derived from one source, but from Several.” ব্রিটিশ সংবিধান কখনই সম্পূর্ণ নয়, সবসময়ে গতিশীল।

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস 

ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলােকে প্রধানত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যথা, (১) সাংবিধানিক আইন এবং (২) সাংবিধানিক রীতিনীতি বা প্রথা।
(১) সাংবিধানিক আইন
 
সাংবিধানিক আইন বলতে সংবিধানের সেই অংশকেই বুঝায় যা আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও বলবৎকৃত হয়। সাংবিধানিক আইনের আবার কয়েকটি উৎস বা উপাদান রয়েছে। এগুলাে নিম্নরূপঃ
ক. ঐতিহাসিক সনদ ও চুক্তিপত্র : ব্রিটিশ সংবিধান একাধিক সনদ, সন্ধি ও চুক্তির সমন্বয়ে গঠিত। ব্রিটেনের রাজনৈতিক জীবনের। ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের জন্য এ সমস্ত চুক্তিপত্র গৃহীত হয়েছে। এ সকল সনদ ও চুক্তির মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার কর্তব্যসমূহ নির্ধারিত হয়ে থাকে। ফলে এগুলাে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উৎসরূপে পরিগণিত হয়েছে।
ব্রিটেনের সংবিধানে যে সকল সনদ বহুলাংশে ভূমিকা রেখেছে, সেগুলাে হলাে ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা (The Magna Carta of 1215), ১৬২৮ সালের অধিকারের। আবেদন (The Petition of Rights of 1628), ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল (Bill of “Rights of 1689), ১৭০৭ ও ১৮০০ সালের যথাক্রমে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের সাথে সংযুক্তিকরণ আইন-(Act of Union with Scotland and Ireland)।
খ. পার্লামেন্ট প্রণীত আইন : পার্লামেন্ট কর্তৃক বিধিবদ্ধ আইনসমূহ ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্ট প্রণীত। সংবিধান সম্পর্কিত আইনসমূহ ব্রিটিশ সংবিধান রচনার পথ প্রশস্ত করেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের, কার্যকাল, লর্ডসভা ও কমন্স সভার মধ্যে শাসনতান্ত্রিক সম্পর্ক নির্ধারণ, মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেতন- ভাতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, পার্লামেন্টের আর্থিক ক্ষমতা, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য উত্তরাধিকারের বিষয় পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
পার্লামেন্ট প্রণীত যে সকল আইন বিশেষ প্রভাবশালী ছিল তাদের মধ্যে
১৬৭৯ সালের কর্পাস অ্যাক্ট (Habeas Corpus Act, 1679);
১৭০১ সালের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন (Act of Settlement, 1701);
১৮৩২, ১৮৬৭ এবং ১৮৮৪ সালের সংস্কার আইন (Reforms Acts of 1832, 1867 and 1884); ১৯১১ এবং ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইন (Parliamentary Acts of 1911 and 949);
১৯৩৮ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (The Representation of the People Act, 1938)
গ. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত (judicial pecisions) : বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উৎসরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিচার বিভাগ বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত মামলা মীমাংসা করার জন্য বিভিন্ন সনদ, চুক্তিপত্র ও বিধিবদ্ধ আইনের ব্যাখ্যা দান করতে গিয়ে নতুন আইনের সৃষ্টি করেন। অধ্যাপক ডাইসী (Dicey) ব্রিটিশ সংবিধানকে ‘বিচারকদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান (Judge-made constitution) বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, “The English constitution for from being the result of legislation in the ordinary sense of the term is the fruit of contests carried on in the courts on behalf of the rights of the individuals”.
(২) সাংবিধানিক রীতিনীতি 
 
সাংবিধানিক রীতিনীতি বা প্রথা বলতে সংবিধানের সেই অংশকে বুঝায়, যা আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়, কিন্তু জনমত ও ঐতিহ্যের বলে প্রযােজ্য হয়। এর মধ্যকার উৎসসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলাে :
ক. প্রথাগত আইন বা সাধারণ আইন (Common Law) : ব্রিটিশ সংবিধান কতকগুলাে প্রথাগত সাধারণ আইন হতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সাধারণ আইন বলতে সেই সকল আইনকে বুঝায় যা পার্লামেন্টের বাইরে ক্রমশ জন্মলাভ করেছে এবং পরে ধীরে ধীরে সমগ্র দেশব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সমবেত হবার অধিকার, নিরাপত্তা বিধানের অধিকার প্রভৃতি সাধারণ আইন হতে উদ্ভূত হয়েছে। মুনরাে (Munro)-এর মতে, “By common law is meant that body of legal rules which grew up in England, apart altogether from any action of parliament, and eventually gained recognition throughout the realm.”.
খ. সাংবিধানিক রীতিনীতি : সাংবিধানিক রীতিনীতি হলাে ব্রিটিশ সংবিধানের সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জে. এস. মিল (J. S. Mill) সাংবিধানিক রীতিনীতিগুলােকে সংবিধানের অলিখিত বিধান’ (Unwritten maxims of the constitution) বলে অভিহিত করেছেন। সাংবিধানিক রীতিনীতি বলতে সেই সমস্ত নিয়ম ও বিধিনিষেধকে বুঝায়, যেগুলাে শাসনব্যবস্থা প্রয়ােগের ক্ষেত্রে উদ্ভূত হয়েছে, যেগুলাে সঠিক অর্থে সাংবিধানিক আইন নয় এবং আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়, অথচ শাসন কার্যের সাথে সংযুক্ত। সকলে এগুলােকে বাধ্যতামূলক বলে স্বীকার করে নিয়েছে।
কে. সি. হুইয়ার (K. c. Wheare) এর মতে, “By convention is meant a whole collection of rules which though not part of the law, are accepted as binding and which regulate political institutions in a country and clearly form a part of the system of government.” ব্রিটেনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তন এসেছে সাংবিধানিক রীতিনীতির মধ্যদিয়ে। ব্রিটেনে রাজশক্তির ক্ষমতা, ক্যাবিনেট ব্যবস্থা, সংসদের কার্যপদ্ধতি, কমওয়েলথ সংক্রান্ত বিষয়বস্তু প্রভৃতি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাংবিধানিক রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। বস্তুত সাংবিধানিক রীতিনীতির ভিত্তিতেই ব্রিটিশ সংবিধান চালু আছে।
গ. সংবিধান সংক্রান্ত গ্রন্থ (Text books on Constitution) : সংবিধান সম্পর্কিত প্রামাণ্য পুস্তকসমূহ ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম উপাদান, যা সংবিধান বিশেষজ্ঞ, প্রখ্যাত আইনবিদ ও লেখকদের দ্বারা রচিত । ব্রিটিশ সংবিধান বিচার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ব্যাপারে এ সকল মৌলিক ও প্রামাণ্য গ্রন্থের মূল্য অপরিসীম। সাংবিধানিক আইন সম্পর্কিত রচনাবলীর মধ্যে অ্যানসনের ‘Law and Custom of the Constitution’, C1-98. ‘Parliamentary Practice, 4. ডাইসী-এর ‘An Introduction to the Law of the Constitution’, বেজহটের ‘The English Constitution’, আইভর জেনিংস-এর The Law and the Constitution, ব্লকস্টোনের ‘Commentaries on the Laws of England’, এ. বি. কীথের ‘The British Cabinet System’  ‘Parliamentary Government in England’ বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
এছাড়াও ব্রিটিশ সংবিধান সম্পর্কে প্রামাণ্য পুস্তক হিসেবে পরিচিত আরও বহু গ্রন্থ রয়েছে। সুতারাং বলা যায় যে, আইন বিশারদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের চিন্তা ও বক্তব্যের দ্বারা ব্রিটিশ সংবিধান অনেকাংশে একটি বিশেষ রূপ লাভ করেছে।
কোন একটি নির্দিষ্ট দলিল অথবা আইনের মধ্যে ব্রিটিশ সংবিধানের সকল উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক সনদ, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, প্রথাগত আইন, সাংবিধানিক রীতিনীতি এবং প্রখ্যাত আইন বিশারদের রচনাবলীই সংবিধানের উৎস। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) তাই বলেছেন, “The English constitution is to be found in the great constitutional landmarks, statutes, judicial decisions, common law and conventions.”
তথ্যসূত্র:
1. তুলনামূলক বৈদেশিক শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতির রূপরেখা, পৃষ্ঠা: ৯-১৪।
2. The United Kingdom Constitution
3. W. B. Munro, The Government of Europe, p. 22-23.
4. Dicey, Law of the Constitution
5. G. C. Moodie, The Government of Great Britain, pp. 1-2
6. Ivor Jennings, The Law and The Constitution, p. 8.

Similar Posts