সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ হচ্ছে দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান রয়েছে। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে প্রাচীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুজিঁবাদের জন্ম। বিপরীতভাবে, সমাজতন্ত্র ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম বিকশিত হয়েছিল।
পুঁজিবাদী অর্থনীতি হচ্ছে মুক্ত বাজার এবং সরকারি হস্তক্ষেপ বিহীন স্বাধীন ব্যবস্থা, যেখানে মূলধনকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর সরকারের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি মূলত সমাজের সংগঠনকে বোঝায়, যা শ্রেণী সম্পর্কের অবসান ঘটায়।
পুঁজিবাদ (Capitalism) কি?
পুঁজিবাদকে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে যাবতীয় উৎপাদন, বাণিজ্য এবং শিল্পের মাধ্যমগুলো মুনাফার জন্য ব্যক্তি বা কর্পোরেশনের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি মুক্তবাজার অর্থনীতি অর্থনীতি নামেও পরিচিত।
এই ব্যবস্থার অধীনে, আর্থিক বিষয়ে ন্যূনতম সরকারি হস্তক্ষেপ থাকে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল উপাদান হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মূলধন আহরণ, মুনাফার উদ্দেশ্য এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার। পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
- উৎপাদনের মাধ্যমগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন থাকে। তারা সেগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করতে পারে যেমনটা তারা উপযুক্ত মনে করে। যদিও সরকার জনকল্যাণে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে।
- এন্টারপ্রাইজ বা উদ্যোকতার স্বাধীনতা আছে, অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি তার পছন্দের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য স্বাধীন।
- আয়ের অসম বন্টন
- অর্থনীতিতে ভোক্তা সার্বভৌমত্ব বিদ্যমান অর্থাৎ উৎপাদকরা কেবলমাত্র সেই পণ্যগুলো উৎপাদন করে যা গ্রাহকরা চায়।
- গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞাপন এবং ছাড়ের মতো সরঞ্জামগুলি ব্যবহার করে এমন সংস্থাগুলির মধ্যে বাজারে চরম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান।
- মানুষকে কঠোর পরিশ্রম এবং সম্পদ অর্জন করতে উৎসাহিত করে।
সমাজতন্ত্র (Socialism) কি?
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বা সমাজতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে সম্পদের মালিকানা, এবং ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ধরনের অর্থনীতির মূল ধারণা হল যে, সকল মানুষের সমান অধিকার রয়েছে এবং এইভাবে প্রতিটি ব্যক্তি পরিকল্পিত উৎপাদনের ফল পেতে পারে।
সম্পদের সুষম বরাদ্দ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে করা হয়, সে কারণেই এটিকে কমান্ড ইকোনমি বা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতিও বলা হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে, উৎপাদনের উপাদান এবং পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারের ভূমিকা নগণ্য। পণ্য, সেবা উৎপাদন ও বিতরণের মৌলিক উদ্দেশ্য হল জনকল্যাণ। সমাজতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে, উৎপাদনের যৌথ মালিকানা বিদ্যমান থাকে। এজন্যই সম্পদগুলি আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
- অর্থনীতিতে আর্থ -সামাজিক উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান।
- ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান দূর করতে আয়ের সমান বন্টন রয়েছে।
- মানুষের কাজ করার অধিকার আছে, কিন্তু তারা তাদের পছন্দের পেশায় যেতে পারে না, কারণ পেশা শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
- যেহেতু পরিকল্পিত উৎপাদন আছে, ভোক্তার সার্বভৌমত্বের কোন স্থান নেই।
- প্রতিযোগিতার অভাব এবং মুনাফার উদ্দেশ্য অনুপস্থিতির কারণে বাজার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে না।
পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের পার্থক্য
১. যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাণিজ্য এবং শিল্প মালিকানাধীন থাকে এবং ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা পুঁজিবাদ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রও একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলো রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. পুঁজিবাদের ভিত্তি হল ব্যক্তিগত অধিকারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা।
৩. পুঁজিবাদ উদ্ভাবন এবং ব্যক্তি স্বতন্ত্রকে উৎসাহিত করে। বিপরীতে, সমাজতন্ত্র সমাজের মধ্যে সাম্যতা এবং ন্যায্যতা প্রচার করে।
৪. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্ষেত্রে উৎপাদনের মাধ্যমগুলো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন।
৫. পুঁজিবাদে পণ্যের দাম বাজার দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং উচ্চমূল্য ধার্য করে একচেটিয়া দাম নির্ধারণ করতে পারে। বিপরীতভাবে, সমাজতন্ত্রে সরকার যে কোন পণ্যের হার নির্ধারণ করে। ফলে, বাজারে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৬. পুঁজিবাদে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা খুব কাছাকাছি থাকে। বিপরীতে, সমাজতন্ত্রে কোন বা প্রান্তিক প্রতিযোগিতা নেই, কারণ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
৭. পুঁজিবাদে সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে ধনী শ্রেণী এবং দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে একটি বড় ব্যবধান গড়ে তোলে, যেখানে সমাজতন্ত্রে আয়ের সমান বন্টনের কারণে এমন কোন ব্যবধান নেই।
৮. পুঁজিবাদে প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব পুঁজি বা মুনাফা সংগ্রহের জন্য কাজ করে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে সম্পদ সকল মানুষ সমানভাবে ভাগ করে নেয়।
৯. পুঁজিবাদে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে যা সমাজতন্ত্রেও বিদ্যমান, কিন্তু সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার উপর বেশি জোর দেয়।
১০. পুঁজিবাদে দক্ষতা বিকশিত হয় বেশি, কারণ ব্যক্তি মুনাফা প্রণোদনা থাকে, যা পণ্য উৎপাদন করতে অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অর্থ উপার্জনের অনুপ্রেরণার অভাব থাকে, যা অদক্ষতার দিকে দাবিত করে।