বিশ্বায়ন কি? বাংলাদেশের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব

বিশ্বায়ন এমন একটি ব্যবস্থা যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সাংস্কৃতিক একটি একক বিশ্ব সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোল্যান্ড রবার্টসন সর্বপ্রথম ‘বিশ্বায়নকে’ সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
সাধারণ অর্থে, বিশ্বায়ন বলতে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান একীকরণকে বোঝায়। এই একীকরণ আন্তর্জাতিক সীমানা জুড়ে মানুষ এবং জ্ঞানের চলাচল ছাড়াও সীমান্তের ওপারে পণ্য, পরিষেবা এবং পুঁজির চলাচলে ভুমিকা রেখেছে।

বিশ্বায়ন কি?

বিশ্বায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ধারণা, বিশ্বাস, পণ্য এবং পরিষেবার মত বিষয়গুলো সারা বিশ্বে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বায়ন হল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষকে সংযুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া।
বিশ্বায়ন বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান আন্তঃনির্ভরতাকে বর্ণনা করে যা পণ্য, পরিষেবা, প্রযুক্তি, এবং বিনিয়োগের প্রবাহ, মানুষ এবং তথ্যের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য দ্বারা সৃষ্ট।
বিশ্বায়ন হচ্ছে দেশগুলোর মধ্যে দ্রুত অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক একীকরণের প্রক্রিয়া।
অ্যান্থনি গিডেনস এর মতে, ‘‘বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় যে আমরা সবাই ক্রমবর্ধমানভাবে এক বিশ্বে বাস করি যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং জাতি পরস্পর নির্ভরশীল হয়।’’
সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন অ্যালব্রো এবং এলিজাবেথ কিং এর মতে, ‘‘বিশ্বায়ন সেই সমস্ত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ একটি একক বিশ্ব সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়।’’

বাংলাদেশের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব

১. যোগাযোগ
উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগ মাধ্যম এবং অতি আধুনিক পরিবহন সুবিধার প্রভাবে বিশ্ব অতি কাছাকাছি এসেছে। এখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে শিখতে ও জানতে পারি দূরতম অঞ্চলে বা দেশে কী ঘটছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলো একটি একক গ্রামের মতো হয়ে গেছে। তারা পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর মতো তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারে।
এটি সম্ভব হয়েছে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভাবনীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশর জলপথ, আকাশপথ, এবং অভ্যন্তরীণ চলাচলে বিশ্বায়নের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজে পৃথিবীর একস্থান থেকে অন্যস্থানে অডিও, ভিডিও, টেক্স আদান প্রদান করতে পারছি।
২. অর্থনীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের দেশেও সীমান্ত-বিহীন বাজারের সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের জিডিপি বেড়েছে। পোশাক শিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে কার্যকরী ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে।
৩. আধুনিক প্রযুক্তি
বিশ্বায়ন এখন মূলত একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত ভিত্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের স্থানান্তর এখন তথ্যের একটি তাত্ক্ষণিক এবং আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব তৈরি করেছে যার ফলে একটি ২৪ ঘন্টা ট্রেডিং নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যাংকিং ও আর্থিক কার্যক্রমকে অনেকাংশে পরিবর্তন করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থ স্থানান্তর এবং ব্যবসার লেনদেন এখন কম্পিউটারের মাউস ক্লিক করার মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখন ইলেকট্রনিক স্ক্রিনের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারি।
৪. রাজনীতি
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিজমের পতন ঘটে এবং পূর্ব-পশ্চিম সংঘর্ষের সমাধান হয়। বিংশ শতাব্দির শেষে এবং একবিংশ শতাব্দি থেকে প্রতিটি দেশ একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক বাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের ঢেউ আমাদের রাজনীতিতেও লেগেছে। আমরা এখন গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ চর্চা করছি।  বাংলাদেশও ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের স্বাদ পাচ্ছে।
৫. খেলাধুলা এবং বিনোদন
খেলাধুলা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিবছর অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। এই ইভেন্টগুলো স্যাটেলাইট দ্বারা বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার করা হয় এবং সারা বিশ্বের লোকেরা সেগুলো সরাসরি দেখে। খেলার স্থানটি বিভিন্ন দেশের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। তারা একে অপরের কাছাকাছি আসে, মতামত, মতামত এবং বন্ধুত্ব ভাগ করে নেয়। বাংলাদেশও এই সুযোগের সুবিধাভোগী।
৬. শিক্ষা ক্ষেত্রে
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও শিক্ষাকে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বায়নের ফলে দাতা দেশগুলো আমাদের সাক্ষরতার হার এবং সামগ্রিক শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা শিক্ষা খাতে তাদের উদার সহায়তা দিয়ে সাড়া দিয়েছে। অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশী অধ্যয়ন বৃত্তির সুবিধা নিচ্ছে।
৭. সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভাব
যদিও বিশ্বায়ন মূলত ব্যবসা, বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাথে যুক্ত, তবে এখন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছে বিশেষ করে সংস্কুতির আদান প্রদানে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এবং ইন্টারনেট দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রথা ও আচরণ নিয়ে আসছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে, বৈশ্বিক সংস্কৃতি ক্রমশ স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে একীভূত হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতি ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়া হয়. একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অনেক বিদেশী ‘রীতিনীতি’ ও ‘বিশ্বাস’ তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে।