দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কি? এর প্রবর্তক

দ্বৈত শাসন কি

বাংলায় দ্বৈত শাসন ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ চালু করেছিলেন এবং ১৭৭২ সাল পর্যন্ত এটি অব্যাহত ছিল। এই ব্যবস্থার অধীনে, বাংলার প্রশাসন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল- একটি দিওয়ানি এবং অপরটি নিজামত। দিওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল এবং নিজামাত (অর্থাৎ শান্তি -শৃঙ্খলা বজায় রাখার অধিকার) বা প্রশাসনিক অধিকার দেওয়া হয়েছিল নবাবকে। ইতিহাসে এটি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা নামে সর্বাধিক বিখ্যাত।
দ্বৈত শাসনের অধীনে, কোম্পানি রাজস্ব হার বাড়িয়ে দেয় এবং রাজস্ব সংগ্রহে কঠোর ব্যবস্থা ব্যবহার প্রয়োগ করে। এই ব্যবস্থায়, মানুষের কল্যাণ কোম্পানি এবং নবাব উভয় দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ছিল। ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের জন্য কালেক্টর নিযুক্ত করেছিল, এবং মানুষকে উচ্চ হারে কর দিতে বাধ্য করা হচ্ছিলো। যেহেতু তারা টাকা দিতে পারছিল না, সেহেতু, তারা গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে পালিয়ে যেতে লাগল। কোম্পানির এসব নীতিগুলো ১৭৭০ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ হয়েছিল।
১৭৬৫ সালে, কোম্পানি দিওয়ানের অধিকার লাভ করেছিল। যেমন, মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় এবং নাগরিক বিচারের অধিকার ইত্যাদি। বাংলার নবাব অবশ্য নিজামতের অধিকার, অর্থাৎ শান্তি -শৃঙ্খলা বজায় রাখার অধিকার, বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সীমান্ত রক্ষা এবং ফৌজদারি বিচারের অধিকার বজায় রেখেছিলেন।
এইভাবে, বাংলার শাসক কর্তৃত্ব দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল নবাবের দায়িত্বে এবং অন্যটি কোম্পানির দায়িত্বে দেওয়া হয়। ক্ষমতার এই বিভাজনের কারণে, ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলায় শাসনকে ‘দ্বৈত সরকার বা শাসন” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক কে?

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা রবার্ট ক্লাইভ চালু করেছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ বাংলার আর্থিক নিয়ন্ত্রণকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে সর্বাধিক সুবিধা পেতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা বাংলার শাসন সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। রবার্ট ক্লাইভ কোম্পানির পক্ষ থেকে দুজন নায়েব (ডেপুটি) দিওয়ান নিয়োগ করেন, যথা বিহারের জন্য রাজা শীতব রায় এবং বাংলার জন্য মুহাম্মদ রেজা খান। কোম্পানি শুধুমাত্র বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের প্রত্যাশা করেছিল এবং এই কাজের জন্য তারা দুজন ভারতীয় নিয়োগ করেছিল।
এই রাজস্ব কীভাবে সংগ্রহ করা হবে এবং বাংলার সাধারণ মানুষের অবস্থার উপর এর প্রভাব কী হবে তা তাদের চিন্তার বিষয় ছিল না। এছাড়া নবাব নাবালক হওয়ায় কোম্পানি রেজা খানকেও নায়েবে নিজাম হিসেবে নিয়োগ দেয়। অতএব, বাংলা শাসনের দায়িত্ব আসলে রেজা খানের হাতে চলে যায় যিনি নায়েব নিজাম এবং নায়েব দিওয়ান উভয় হিসাবে কোম্পানির সেবক ছিলেন। কোম্পানি এই চাকরকে তার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কর্মে চাপ দিতে পারত।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পর, বাংলার নবাব নজম-উদ্-দৌলাকে ৫৩ লক্ষ টাকা দেবার বিনিময়ে রাজস্ব আদায় এবং দেওয়ানি মামলার ভার গ্রহণ করলেন। দেশ শাসনের দায়িত্ব আগের মতোই নবাবের হাতে রইলো। এই ব্যবস্থা ইতিহাসে দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় বাংলার নবাব সামান্য বৃত্তিভোগী কর্মচারীতে পরিণত হলেন। আর প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ইংরেজ কোম্পানি এদেশের প্রকৃত প্রভু হয়ে বসলেন।
নবাব ও কোম্পানির মধ্যে এই ক্ষমতা ভাগাভাগির ফলে দেশশাসন ও প্রজাসাধারনের মঙ্গল বিধানের দায়িত্ব কেউই পালন করত না। ফলে বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ দেখা দেয়। ক্ষমতাহীন নবাব সেই বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হন। কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব বিভাগের দুই সহকারী রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের শোষণ ও অত্যাচারে প্রজাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। পরিণতিতে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।

Similar Posts