আইনের সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বোধগম্যতার জন্য আইনের উৎসগুলো জানা অপরিহার্য। আইনের উৎস বলতে সেই উৎস সমূহকে বোঝায় যেখান থেকে আইন বা মানবিক আচরণের বাধ্যতামূলক নিয়মগুলো উদ্ভূত হয়েছে। আইনের উদ্ভব এবং উৎস সম্পর্কে আইনবিদদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। যেহেতু ‘আইন’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে, তাই আইন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন কোণ থেকে আইনের উৎসগুলোর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা করেছেন।
উদাহরণ স্বরূপ, অস্টিন সার্বভৌমকে আইনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন কিন্তু স্যাভিনি এবং হেনরি মেইন কাস্টমকে আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। ধর্মতত্ত্ববিদরা ধর্মীয় গ্রন্থকে আইনের উৎস হিসাবে বিবেচনা করে। যদিও আইনের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন দাবি এবং পাল্টা দাবি রয়েছে, তবে এটি সত্য যে প্রায় সমস্ত সমাজের আইন কিছু সাধারণ উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
ইংরেজ আইনবিদ সালমন্ড, আইনের উৎসগুলোকে আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস এবং আইনের উপাদান উৎস হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন।
যাইহোক, বেশিরভাগ আইন ব্যবস্থাই আইনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। একই সাথে, এটাও সমানভাবে সত্য যে, কোনো কোনো দেশের আইন ব্যবস্থায় কখনো কখনো প্রথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার কিছু আইন ব্যবস্থায়, আদালতের সিদ্ধান্ত আইন হিসেবে বাধ্যতামূলক।
আধুনিক সমাজে আইনের কয়েকটি প্রধান উৎস চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন,
১. কাস্টম বা প্রথা
২. বিচারিক রূল
৩. আইনসভা
৪. ধর্মীয় গ্রন্থ
৫. অধ্যাদেশ
৬. কনভেনশন
৭. জনমত
৮. ন্যায়বোধ
কাস্টম বা প্রথা
কাস্টম বা প্রথা বৈধ হওয়ার জন্য কোন বাধা ছাড়াই একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য অবিচ্ছিন্নভাবে পালন করা আবশ্যক। উপরন্তু, এটি সাধারণ জনগণের মতামত এবং নৈতিকতা দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। যাইহোক, প্রতিটি প্রথা আইন হতে হবে এমন না।
কাস্টম হলো সেই দীর্ঘ সময়ের অভ্যাস বা অলিখিত নিয়ম যা বাধ্যতামূলক চরিত্র অর্জন করেছে। প্রাচীন সমাজে, প্রথাকে আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হত। প্রকৃতপক্ষে, এটি আইনের আসল উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে এবং আধুনিক সভ্যতার আবির্ভাবের সাথে সাথে আইনের উৎস হিসেবে প্রথার গুরুত্ব কমে যায় এবং অন্যান্য উৎস যেমন বিচারিক রূল ও আইনসভা গুরুত্ব পায়।
প্রথা যে আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথা আইন কিনা তা নিয়ে দুটি মত রয়েছে। অস্টিনের মতো আইনবিদরা আইন হিসাবে প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন কারণ এটি সার্বভৌমের ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়নি। সেবিগনি এর মতে, আইনবিদরা প্রথাকে আইনের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে আইনের আসল উৎস হল জনগণের ইচ্ছা, সার্বভৌম ক্ষমতার ইচ্ছা নয়। সমাজের প্রথা ও ঐতিহ্যে মানুষের ইচ্ছা সবসময়ই প্রতিফলিত হয়েছে। কাস্টম তাই আইনের প্রধান উৎস।
কাস্টমস বা প্রথাকে মোটামুটিভাবে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন,
ক. অনুমোদন বিহীন কাস্টম: এই ধরনের কাস্টম প্রকৃতিতে অ-বাধ্যতামূলক এবং জনমতের কারণে অনুসরণ করা হয়।
খ. অনুমোদন সহ কাস্টম: এই কাস্টম প্রকৃতিতে বাধ্যতামূলক এবং রাষ্ট্র দ্বারা প্রয়োগ করা হয়। অনমোদিত কাস্টমকে আরও নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন,
১. আইনি প্রথা: আইনি প্রথা হল একটি প্রথা যার কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ। এটি আদালত দ্বারা স্বীকৃত এবং প্রয়োগ করা হয়। আইনি প্রথাকে আরও নিম্নলিখিত দুটি প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে:
সাধারণ কাস্টম: এই ধরনের কাস্টম সমস্ত দেশে জুড়ে বিরাজ করে।
স্থানীয় কাস্টম: স্থানীয় কাস্টম দেশের একটি অংশ বা দেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য।
২. প্রচলিত প্রথা: প্রচলিত প্রথা চুক্তির উপর বাধ্যতামূলক। যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তিতে প্রবেশ করে, তখন তারা সেই বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠিত প্রথা অনুসারে চুক্তিটি করে। উদাহরণস্বরূপ, ভাড়া প্রদানের বিষয়ে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটেদের মধ্যে একটি চুক্তি এই বিষয়ে প্রচলিত কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হবে৷
আইনসভা
আধুনিক সময়ে, আইন প্রণয়নে আইনসভাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘আইন’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ লেজিস থেকে এসেছে যার অর্থ ‘আইন’ এবং লাতুম যার অর্থ “বানানো” বা “সেট”। এটি সার্বভৌম কর্তৃত্ব দ্বারা সমর্থিত, এবং এটি সরাসরি প্রণীত এবং রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত। এতে আইন প্রণয়নের প্রতিটি পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আইনসভার প্রকার
সুপ্রিম আইনসভা: যখন আইনগুলো সরাসরি সার্বভৌম দ্বারা প্রণীত হয়, তখন এটি সর্বোচ্চ আইন হিসাবে বিবেচিত হয়। সর্বোচ্চ আইনের একটি বৈশিষ্ট্য হল যে সার্বভৌম ছাড়া অন্য কোন কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনগুলো এই বিভাগে পড়ে, কারণ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনও একই শ্রেণীতে পড়ে। যাইহোক, ভারতে সংসদের ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
অধস্তন আইনসভা: অধস্তন আইন হল এমন আইন যা সর্বোচ্চ বা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রণীত হয়। এটি সার্বভৌমের অর্পিত কর্তৃত্বের অধীনে প্রণীত হয়। এই ধরনের আইনের উৎপত্তি, বৈধতা, অস্তিত্ব এবং অব্যাহত থাকা সম্পূর্ণরূপে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অধস্তন আইনকে আরও নিম্নলিখিত প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন,
ক. স্বায়ত্তশাসিত আইন: যখন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে আইনের অধীনে স্বীকৃত নিয়ম ও প্রবিধান তৈরির ক্ষমতা প্রদান করা হয়, তখন এই জাতীয় সংস্থার দ্বারা প্রণীত আইন স্বায়ত্তশাসিত আইনের অধীনে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণীত আইন।
খ. বিচারিক বিধি: কিছু দেশে, বিচার বিভাগকে তাদের প্রশাসনিক পদ্ধতির জন্য নিয়ম প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে পদ্ধতি ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
গ. স্থানীয় আইন: কিছু দেশে, স্থানীয় সংস্থাগুলোকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। তারা তাদের নিজ নিজ উপ-আইন তৈরি করার অধিকারী হয়।
ঘ. নির্বাহী কর্তৃক প্রণীত আইন: বেশিরভাগ আধুনিক রাষ্ট্রে, সার্বভৌমত্ব সাধারণত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিভক্ত। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যেমন আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ তিনটি ভিন্ন কার্যের সাথে ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের প্রধান দায়িত্ব আইনসভার উপর ন্যস্ত, অন্যদিকে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে নির্বাহী বিভাগের ওপর। যাইহোক, আইনসভা তার কিছু আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা নির্বাহী অঙ্গগুলোতে অর্পণ করে যেগুলোকে অর্পিত আইনও বলা হয়।
বিচারিক রূল বা আদেশ
বিচারিক রূল বলতে উচ্চতর আদালতের পূর্বের নির্ধারিত রায়গুলোকে বোঝায় যা বিচারকরা অনুসরণ করতে বাধ্য। একটি নির্দিষ্ট দেশের আইন ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া মামলাগুলোর এই বাধ্যতামূলক চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিবিন্যাস বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগীয় রূল আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, তবে এটি আইনসভার মতো আধুনিক নয় বা প্রথার মতো পুরানো নয়।
বেশিরভাগ উন্নত আইন ব্যবস্থায়, বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক সমাজে, নাগরিকের অধিকারগুলো সাধারণত আইন দ্বারা প্রদান করা হয়। বিচার বিভাগের প্রধান কাজ এই অধিকারগুলোর উপর বিচার করা। বিচারকরা আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত প্রথার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেন এবং আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে সৃজনশীল ভূমিকাও পালন করেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন নীতি এবং নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে যা সাধারণত নিম্ন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক।