আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) শব্দটি Bureau (ফরাসি): যার অর্থ ছোট ডেস্ক এবং Kratein (গ্রীক): যার অর্থ শাসন করা। সুতরাং, আমলাতন্ত্র বলতে বোঝায় অফিস দ্বারা শাসন করা। আধুনিক সময়ে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে প্রথম ধারনা দেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (1864-1920)। তিনি একটি জটিল ব্যবসা সংগঠিত করার একটি যুক্তিসঙ্গত উপায় হিসাবে আমলাতন্ত্র ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নেওয়া হয়।
আমলাতন্ত্র একাধিক বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা, যাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব রয়েছে। আমলাতন্ত্র সরকারী সংস্থা, অফিস, স্কুল পর্যন্ত বিস্তৃত।
উদাহরণস্বরুপ, মার্কিন সরকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রে নিযুক্ত আমলারা নির্বাচিত কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রণীত আইন ও নীতি কার্যকরভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ ও প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২০০০ সরকারী সংস্থা, বিভাগ, এবং কমিশনের সবই আমলাতন্ত্রের উদাহরণ।
আমলাতন্ত্র হল একটি সংস্থা, যা সরকারী বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, বিভিন্ন নীতিনির্ধারক বিভাগ বা ইউনিট নিয়ে গঠিত। যারা আমলাতন্ত্রে কাজ করেন তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে আমলা (bureaucrat) হিসেবে পরিচিত।
আমলাতন্ত্র হল একটি সরকার ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের অনুক্রমিক প্রশাসনিক কাঠামো আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আমলাতন্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার ১৯২১ সালের বই “ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি“-তে ওয়েবার যুক্তি দিয়েছিলেন যে একটি আমলাতন্ত্র সংস্থা সবচেয়ে দক্ষ কাঠামো প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ দক্ষতা, নিশ্চিততা, ধারাবাহিকতা এবং উদ্দেশ্যের একতা এর মূল বৈশিষ্ট্য। যাইহোক, তিনি আরো সতর্ক করেছিলেন যে অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, এটি মানুষকে নৈর্ব্যক্তিক, অযৌক্তিক এবং অনমনীয় নিয়মের “লোহার খাঁচায়” আটকে রাখতে পারে।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য বলেছেন যেমন,
১. টাস্ক স্পেশালাইজেশন: শ্রমের বিভাজনের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি উপকৃত হয় এবং কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল যে জানে তার উপর কাজগুলো অর্পিত হয়।
২. অনুক্রমিক কর্তৃপক্ষ: শ্রেণীবদ্ধ একাধিক স্তর আমলাতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে নীচের স্তরগুলোর কাজ উচ্চতর স্তরগুলোর দ্বারা তত্ত্বাবধান করা হয়। সংগঠিত এরুপ অনুক্রমিক কাঠামোতে যোগাযোগ, প্রতিনিধি দল এবং তত্ত্বাবধান অনেকটা সহজ হয়।
৩. কর্মজীবন অভিযোজন: কর্মচারীদের তাদের ক্ষমতা, পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে নির্বাচিত করা হয়। এটি কর্মীদের আরও বিশেষীকরণ করতে এবং পদোন্নতিতে যথাযথ পদক্ষেপে উপরে উঠতে সক্ষম করে।
৪. নিয়ম এবং প্রয়োজনীয়তা: আমলাতন্ত্রের একটি প্রণীত নিয়ম আছে যা আমলাদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে। এছাড়া সময়ে সময়ে, নতুন নিয়ম উচ্চ পদস্থ পরিচালকদের দ্বারা প্রয়োগ করা হতে পারে।
ক. শ্রম বিভাজন: এটি কাজ সহজ করে তোলে এবং বিশেষীকরণের দিকে নিয়ে যায়।
খ. দক্ষতা: এতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। অনুক্রমের তাত্ক্ষণিক পরিচালকদের তত্ত্বাবধানে কাজটি দক্ষতার সাথে সঞ্চালিত হয়।
গ. জবাবদিহিতা: দায়িত্ব পালনে সরকারী কর্মকর্তা এবং আমলাদের জবাবদিহি করতে হয়। যদি কিছু ভুল হয়ে যায় তাহলে প্রতিষ্ঠান দায়ী।
ঘ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সরকারি সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত আমলাদের কাছে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থাপকদের দ্বারা হস্তান্তর করা হয় এবং ক্রমানুসারে তাদের উপরে থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
ঙ. বিধি ও প্রবিধান: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্ণিত নিয়ম ও প্রবিধানের কারণে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে তাদের আনুগত্যকে একটি পূর্বশর্ত করে তোলে, যার ফলে নিয়ম এবং প্রোটোকলের কাঠামোর সাথে অমনযোগী হওয়ার সুযোগ হ্রাস পায়।
চ. প্রশাসনের সহজতা: এটি প্রশাসনকে সহজ করে তোলে। একটি কাঠামোগত অনুক্রমের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও যুক্তিযুক্তভাবে সাজানো হয়েছে।
ক. লাল ফিতার দৈরত্ব: আমলাতন্ত্র, তার চরিত্র দ্বারা, একটি নির্দিষ্ট নিয়ম এবং প্রবিধান অনুসরণ করে। কিন্তু এই লাল ফিতার দৈরত্বের কারণে প্রশাসনিক কজের বিলম্বের সৃষ্টি হয়।
খ. আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মের জটিল সেট প্রায়ই দীর্ঘ বিলম্বের কারণ হয়।
গ. আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি: আমলাতন্ত্রের উচ্চ স্তরে দুর্নীতি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত বিপর্যয়কর হতে পারে।
ঘ. লক্ষ্যের পরিবর্তন: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কাজ করার প্রক্রিয়াটি জটিল এবং প্রায়শই তাদের লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটে।
ঙ. কাগজের কাজ: এমনকি খুব সাধারণ কাজের জন্যও প্রচুর কাগজপত্রের প্রয়োজন হতে পারে।
চ. স্বজনপ্রীতি: আমলাতন্ত্রে স্বজনপ্রীতি একটি প্রধান সমস্যা। শীর্ষে বসে থাকা আমলারা তাদের নিজস্ব লোকদের পক্ষপাতী করে এবং তাদের দ্রুত উপরে উঠতে সহায়তা করতে পারে।
ছ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: আমলাতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ও প্রবিধানের উপর ভিত্তি করে। এর কারণে নতুন উপায়গুলো অন্বেষণ করা হয় না।