নেপালের মাওবাদী আন্দোলন সারা বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত আন্দোলন সমূহের মধ্যে একটি। দীর্ঘকাল গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার পর, দলটি রাজতন্ত্রকে হঠিয়ে জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু খুব বেশি দিন তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ভারতের আধিপত্য এবং জোটভুক্ত দলসমূহের কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষমতার ৮ মাস পরেই প্রধানমন্ত্রী ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৯৬ সাল থেকে, মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠে। একটি ধ্বংসাত্মক দশকব্যাপী যুদ্ধের পর, ২০০৬ সালে সর্বদলীয় গণ আন্দোলনে রাজতন্ত্র বিরোধীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে। ৬ এপ্রিল, রাজার ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাওবাদীরা সহ সব রাজনৈতিক দল সারা নেপাল জুড়ে এক গ্রান্ড এলায়েন্স গঠন করে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে, একটি সাত-দলীয় জোট সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেয়, সেই সাথে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান গ্রহণ করে।
মে ২০০৮ সালে, নেপালের রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় এবং নেপাল একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। যদিও নেপালে রাজতন্ত্রের পতন ও উৎখাতের ঘটনা ২০০৬ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল। নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, মাওবাদী সহ জনসংখ্যার সমস্ত অংশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি নেপালি নাগরিকের মনে হয়েছিল যেন সংসদে তাদের কণ্ঠস্বর রয়েছে।
প্রথম অবস্থায়, সেনাবাহিনী ও পুলিশকে রাজার অধীনস্থতা ও নির্দেশে পরিচালিত হবার আইন বাতিল করে তাদেরকে জাতীয় সংসদ,অর্থাৎ জনগণের অধীনে আনা হয়। এটি ছিল ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (UCPN) বা যারা পপুলারলি মাওবাদী বলে পরিচিত তাদের সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল।
১৯৯৪ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (UCPN) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের নেতা ছিলেন পুষ্প কমল দাহাল যিনি শুধু ‘প্রচণ্ড’ নামে পরিচিত। ১৯৯৬ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি, নেপালের মাওবাদীরা তৎকালীন সরকারের কাছে ৪০ দফা দাবীনামা পেশ করে। সরকারকে তারা জানিয়েছিল যে, যদি এই দাবি মেনে না নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তারা রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে। লিখিত এই পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন মাওবাদী পার্টির দ্বিতীয় নেতা বাবুরাম ভট্টরায়। তিনি ছিলেন মূলত মাওবাদী সহ কয়েকটি ছোট দলের জোট “ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট” এর তৎকালীন চেয়ারম্যান। আর তখন মাওবাদী পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন পুস্পকমল দাহাল।
মাওবাদীদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নেপালের রাজনৈতিক সংকটে নেপালের করণীয় নির্ধারণ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি নেপালের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে একমতে আনা। এবং রাজতন্ত্র উৎখাতের জন্য সকল পক্ষকে একটি সর্ব সম্মত সাধারণ অবস্থানে নিয়ে আসা। সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের ধারণা এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করবার কৃতিত্ব একমাত্র মাওবাদীদের।
নেপালের মাওবাদী আন্দোলন থেকে শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম বিপ্লবী রাজনীতির নীতিগত দিক নয়, বরং কৌশল হচ্ছে নীতিগত দিক। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে অর্জন সম্ভব, সেইসাথে তা অর্জনের কৌশল অবলম্বন করা। আবার সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তা আদায় করে নিতে মাওবাদীরা পিছপা নয়।
তারা দেখাতে পেরেছে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে রাজতন্ত্র বিরোধী সমাজের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার এবং নেপালি জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করবার পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি গণ মানুষের রাজনৈতিক ক্ষেত্র গড়ে তোলা যার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের দাবি দাওয়া প্রকাশ ও রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ লাভ করবে।
মাওবাদী আন্দোলনের ফলে নেপালের বর্তমান অবস্থা,
১. রাজতন্ত্র থেকে নেপালকে প্রজাতন্ত্র (Republic) রূপান্তরের সাফল্য।
২.স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নেপালি জনগণের মধ্যে ঐক্য।
৩. ভারতের ঔপনিবেশিক সুবিধার ভোগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।
৪. জনগণের মধ্যে বিপ্লবী দীক্ষা ও চেতনার সম্প্রসারণ।
৫. ভারতীয় আধিপত্যবাদের পাশাপাশি দেশিয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমানভাবে লড়াই।
প্রতিটি ক্ষেত্রে মাওবাদিরা নির্ধারকের ভূমিকা রেখেছে এ-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। নেপালী মাওবাদী দলের মতে, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয়নি। চীনে যেভাবে মাও সেতুং আধা সামন্তবাদ এবং আধা ঔপনিবেশবাদী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তেমনি নেপালের পরিস্থিতিও একই। আন্দোলনের এ-ধারাকে গ্রহণ করায় দলটি মাওবাদী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।