ইংরেজি “imperialism” শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘imperium‘ থেকে এসেছে যার অর্থ “নিরঙ্কুশ ক্ষমতা”। সাম্রাজ্যবাদ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি ধনী ও শক্তিশালী দেশ অন্য দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে বা অন্য দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা করে।
সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য দেশকে শোষণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে যতটা সম্ভব নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করা।
২০ শতকের শুরুতে, অর্থনীতিবিদ জে.এ. হবসন তার “Imperialism: A Study,” বইতে দেখিয়েছেন যে সাম্রাজ্যবাদ প্রায়শই বিজিত দেশের সম্পদ শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করে সাম্রাজ্য তৈরির অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রদান করে।
ইউরোপীয় দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পর্তুগিজ, স্পেন) ১৮৭০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ৯ মিলিয়ন বর্গমাইল অঞ্চল দখল করে নেয়, যা বিশ্বের ভূমির এক পঞ্চমাংশ। সেই সময়ে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছিল। জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং গ্রেট ব্রিটেন তাদের সম্পদ তৈরি করতে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করত।
সাম্রাজ্যবাদ প্রায়শই নৈতিকভাবে নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রাচীন ইতিহাসের মধ্যে রয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে গ্রীক সাম্রাজ্যবাদ এবং বেনিটো মুসোলিনির অধীনে ইতালীয় সাম্রাজ্যবাদ।
সাম্রাজ্যবাদ অর্থনীতিকে একটি “শূন্য-সমষ্টি” খেলা হিসাবে দেখে। অর্থাৎ পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ পরিমাণে সম্পদ রয়েছে, কেউ ধনী হওয়ার জন্য কাউকে অবশ্যই দরিদ্র হতে হবে।
সাম্রাজ্যবাদ হল একটি দেশের ক্ষমতাকে অন্য অঞ্চলে প্রসারিত করার বা অন্য দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করার নীতি।
সাম্রাজ্যবাদ হল অন্যান্য অঞ্চল ও জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ লাভের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্রীয় নীতি, অনুশীলন বা ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের প্রচার।
সাম্রাজ্যবাদ হল ক্ষমতার স্বভাবগত অনুশীলন। জোসেফ কনরাড তার ১৯০২ সালের উপন্যাস “হার্ট অফ ডার্কনেস”-এ লিখেছেন, “since your strength is just an accident arising from the weakness of others. They grabbed what they could for the sake of what was to be got.
সাম্রাজ্যবাদ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি ধনী ও শক্তিশালী দেশ অন্য দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আদর্শগত, জনসংখ্যা এবং বৈজ্ঞানিক কারণ।
১. অর্থনৈতিক কারণ
আংশিকভাবে, সাম্রাজ্যবাদ ছিল শিল্প বিপ্লবের ফল। ১৮ শতকে শিল্প বিপ্লবে ইউরোপে উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধির কারণে উপনিবেশগুলো লাভজনক বাজারে পরিণত হয়েছিল। যেখানে তারা শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই তাদের পণ্য বিক্রি করতে পেরেছিল।
২. রাজনৈতিক কারণ
গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র এবং স্থল পথ নিয়ন্ত্রণের জন্য কৌশলগত কিছু স্থান জয় করেছিল। এছাড়া আঞ্চলিক সম্প্রসারণ বিশ্বে একটি দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং জাতীয় গর্বকে শক্তিশালী করতেও কাজ করত।
৩. আদর্শগত কারণ
শ্বেতাঙ্গ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি এবং সভ্য জনগণের আদর্শ ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ ঘটায়। পশ্চিমে, ১৯ শতকের সময়, বর্ণবাদী মতাদর্শগুলি খুব শক্তিশালী ছিল। পশ্চিমারা নিশ্চিত ছিল যে শ্বেতাঙ্গ জাতি উচ্চতর ছিল এবং এটি তাদের অন্যান্য জাতিদের উপর আধিপত্য করার অধিকার দিয়েছে।
৪. ধর্মীয় কারণ
সাম্রাজ্যবাদ অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ম প্রচারের মিশনে বিস্তার লাভ করে। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের মিশনারির মিশনগুলি এশিয়া, আফ্রিকা এবং ওশেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
৫. জনসংখ্যার কারণ
১৯ শতকে, পশ্চিমা দেশগুলোতে জনসংখ্যা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্ব দেখা দেয়। ফলে ইউরোপীয়দের বিদেশে নতুন জমি ও পেশার সন্ধানে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় নতুন সুযোগের সন্ধানে উপনিবেশে চলে গিয়েছিল।
৬. বৈজ্ঞানিক কারণ
বৈজ্ঞানিক কৌতূহলও সাম্রাজ্য বিস্তারে অবদান রেখেছিল। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন রুট আবিষ্কারের অভিযান চালিয়েছিল।
আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের নতুন রুট আবিষ্কার সাম্রাজ্যবাদের চেতনাকে উন্নীত করেছে। সমুদ্রপথের আবিষ্কার ব্যবসায়ী এবং সৈন্যদের জন্য দেশগুলির প্রচুর সম্পদ শোষণের পথ প্রশস্ত করেছিল।
১. নেপোলিয়নিক যুদ্ধ (1803-1815)
নেপোলিয়ন অন্যান্য দেশ আক্রমণ করে ফরাসি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। তিনি বেশিরভাগ ইউরোপ জয় করতে সক্ষম হন, কিন্তু ওয়াটারলু যুদ্ধে তার পরাজয়ের পর তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
২. রোমান সাম্রাজ্য (753 BC-476 AD)
রোমান সাম্রাজ্য ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। এটি ব্রিটেনের হার্ডিয়ানস ওয়াল রিলিক সীমানা থেকে উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। শেষ রোমান সম্রাট রোমুলাস অগাস্টাস ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাচ্যুত হন।
৩. ব্রিটিশ সাম্রাজ্য (1583-1945)
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি এবং যার বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল। এটি উত্তর আমেরিকা থেকে আফ্রিকা এবং ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। বিংশ শতাব্দীতে, জাতীয়তাবাদ এবং উপনিবেশকরণ আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে।
৪. আফ্রিকায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ (1870-1900)
ইউরোপীয় দেশগুলো ১৮ শতকের শেষের দিকে, আফ্রিকাকে উপনিবেশ করার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।
৫. আমেরিকার সম্প্রসারণ (1803-1853)
১৯ শতকের গোড়ার দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। ১৮০৩ সালের লুইসিয়ানা ক্রয় আমেরিকার মহাদেশীয় সম্প্রসারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল, কারণ এটি দেশের আকার দ্বিগুণ করেছে। ১৮৪৬-৪৮ সালের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধ ছিল আমেরিকার পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা মেক্সিকো টেক্সাস ছেড়ে দেওয়া এবং মেক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল।
৬. রাশিয়ান সাম্রাজ্য (1721-1917)
রাশিয়ান সাম্রাজ্য পূর্ব ইউরোপ থেকে সাইবেরিয়া এবং আর্কটিক মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৭. সোভিয়েত রাশিয়া (1922-1991)
সোভিয়েত রাশিয়া ছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি রাষ্ট্র। এটি পূর্ব ইউরোপ থেকে সাইবেরিয়া এবং আর্কটিক মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়া বলপ্রয়োগ ও কূটনীতির মাধ্যমে এসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। এতে আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৮. স্প্যানিশ সাম্রাজ্য (1492-1898)
স্প্যানিশ সাম্রাজ্য ছিল একটি বৈশ্বিক সাম্রাজ্য যা ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার অঞ্চলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। স্প্যানিশরা নৌশক্তির মাধ্যমে নতুন ভূমি খোঁজার জন্য বিশ্বজুড়ে অভিযাত্রী পাঠাত। এই স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যিনি ১৪৯২ সালে আমেরিকার সন্ধানকারী প্রথম ইউরোপীয় ছিলেন।
৯. ডাচ সাম্রাজ্য (1595-1962)
ডাচ সাম্রাজ্য ছিল একটি বৈশ্বিক সাম্রাজ্য যা ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার অঞ্চলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ডাচ সাম্রাজ্য ১৭ শতকে তার শিখরে পৌঁছেছিল কিন্তু ১৮ শতকে পতন হতে শুরু করে। ডাচ সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত ২০ শতকের গোড়ার দিকে তার বেশিরভাগ উপনিবেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
১০. পর্তুগিজ সাম্রাজ্য (1415-1999)
পর্তুগিজরা ছিল প্রথম ইউরোপীয় যারা দূরপ্রাচ্যের অন্বেষণ এবং উপনিবেশ স্থাপন করেছিল এবং তারা অনুসন্ধানের যুগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। পর্তুগিজ সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তার বেশিরভাগ উপনিবেশ থেকে সরে যায়।
১১. অটোমান সাম্রাজ্য (1299-1922)
অটোমান সাম্রাজ্য ছিল ইতিহাসের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলির একটি। এটি আধুনিক অস্ট্রিয়া থেকে পারস্য উপসাগর এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে বলকান পর্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছিল। অটোমান সাম্রাজ্য ছিল একটি মুসলিম সাম্রাজ্য। অটোমানদের একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি ছিল এবং তাদের সফল অভিযানের মাধ্যমে অনেক অঞ্চল জয় করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার পর, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
১২. ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ (1800-1962)
আফ্রিকায় ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ১৮০০ সালে সেনেগালে একটি ফরাসি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। আফ্রিকায় ফরাসি সাম্রাজ্য ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে সমস্ত মহাদেশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ফরাসি সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত ১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে উপনিবেশ থেকে সরে যায়।