ন্যায়পাল কি?
ন্যায়পাল শব্দটির ইংরেজি Ombudsman যার অর্থ প্রতিনিধি বা মুখপাত্র। ন্যায়পাল বলতে এমন একজন রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কর্মকর্তাকে বোঝায়, যিনি যেকোন বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারেন।
ন্যায়পাল হলেন সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা, যিনি ব্যবসা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী বিভাগ বা অন্যান্য পাবলিক সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ (সাধারণত বেসরকারী নাগরিকদের দ্বারা দায়ের করা) তদন্ত করেন এবং উত্থাপিত দ্বন্দ্ব বা উদ্বেগগুলো মধ্যস্থতা বা সুপারিশ করার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেন।
ন্যায়পাল পদের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের সমতা ও সততা বিধান এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রশাসনের যেকোন ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
১৮০৯ সালে, সুইডেনের সংবিধানে ন্যায়পাল (Ombudsman) পদের সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ সরকারী চাকুরীজীবী, বিচারক বা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যগন কতৃক দেশের আইন যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না এবং তাদের বে-আইনী কাজ ও অহেতুক হয়রানি কারনে জনগনের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা পদদলিত হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা -নীরিক্ষা ও তদন্ত করে দেখার জন্য “অভিযোগ তদন্ত কারী” দপ্তর হিসাবে ন্যায়পাল পদের উৎপওি ঘটে।
সুইডিশ ভাষায় ন্যায়পাল বলতে এমন একজন সরকারি মুখপাত্র বা প্রতিনিধি কিংবা সরকারি কর্মকর্তাকে বোঝায় যিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কংগ্রেসের সদস্যরা জাতীয় স্তরে ন্যায়পাল হিসাবে কাজ করে।
সব দেশেই ন্যায়পাল আইনসভা কর্তৃক নিযুক্ত হন। আইনসভায় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ সর্বসম্মতিক্রমে ন্যায়পাল নির্বাচন করেন। রাজনৈতিক দলসমূহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই ন্যায়পালকে যথাযথ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সরকারি আমলা ও সাধারন নাগরিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী সরকারি এজেন্ট হিসেবে তিনি থাকেন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে।
১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে। ৭৭নং অনুচ্ছেদের অধীনে, ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান এর শাসনামলে (The Ombudsman Act,1980) পাস হয়। তবে আজ পর্যন্ত তা কার্যকর করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন,
- সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।
- সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।
- ন্যায়পাল তাঁহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।
ন্যায়পালের কার্যাবলী
- সরকারি আমলা ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী সরকারি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
- মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতা।
- বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের তদন্ত ও সে সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করার ক্ষমতা।
- জনগনের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা -নীরিক্ষা ও তদন্ত করে দেখার জন্য “অভিযোগ তদন্ত কারী” দপ্তর হিসাবে ন্যায়পাল পদের সৃষ্টি।
- ন্যায়পাল তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করবে।
- ন্যায়পাল স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য।
- বেসামরিক প্রশাসন ও আদালতের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান।
- বেআইনি কার্যকলাপ, কর্তব্যে অবহেলা ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত।
- প্রতারণামূলক অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কার্যকলাপের তদন্ত পরিচালনা।
- দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সংবিধানের বিধি বা দেশের আইন লঙ্ঘন কিংবা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ভঙ্গ করলে ন্যায়পাল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
- ন্যায়পালের শাস্তি প্রদানের কোনো ক্ষমতা নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন জনসাধারণের সম্পত্তি বেদখল হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আদালতে অভিযুক্ত করার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণের জন্য তিনি প্রস্তাব দিতে পারেন।
- দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিসমূহের ত্রুটি নির্দেশ করার অধিকারও তার এখতিয়ারভুক্ত।