HISTORY

বক্সারের যুদ্ধ – কারণ ও ফলাফল

1 min read

বক্সারের যুদ্ধ

বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতীয় ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট, কারণ এটি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করেছিল। এই যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হয়, এবং সেই সাথে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনের অবসান ঘটায়। যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারে আধিপত্য বিস্তার করে। তারা ভারতে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয় এবং বৃহৎ অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।
২২ অক্টোবর, ১৭৬৪ সালে, হেক্টর মুনরোর নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনীর মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে বক্সারের যুদ্ধ শেষ হয়।

পটভূমি
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর, ক্লাইভ মীর জাফরকে বাংলার মসনদে বসান। ১৭৬০ সালে ক্লাইভ ইংল্যান্ডে চলে গেলে, মীরজাফর অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি ইংরেজদের বিশ্বাস ও সমর্থন হারান। অধিকন্তু, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বারংবার টাকার দাবি মেটাতে পারছিলেন না। ফলে, হলওয়েল ও ভেনসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭৬০ সালের অক্টোবরে মীর কাসিমকে মসনদে বসায়। নবাবীর বিনিময়ে মীর কাসিম কোম্পনীর নিকট  বহু অর্থ উপঢৌকন দেন। তাছাড়া, তিনি বর্ধমান, মেদেনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা কোম্পানিকে দান করে দিতে বাধ্য হন।
মীর কাসিম (১৭৬০-৬৩ খ্রি.) অনেকটা স্বাধীনচেতা ছিলেন। নবাব এ সময় কয়েকজন হিন্দু কর্মচারী, জমিদার ও ব্যবসায়ীর অবাধ্যতায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত লাভ করার জন্য মীর কাসিম তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসায় নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। কোম্পানির কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করায়, তিনি সব বণিকের পণ্যদ্রব্যের ওপর হতে শুল্ক রহিত করে দেন। এই ব্যবস্থার ফলে বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া ও বিশেষ সুবিধা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি ইংরেজদের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন।
স্বাধীনচেতা মীর কাসিমের বিভিন্ন পদক্ষেপে ইংরেজরা তাঁর ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে শীঘ্রই বিরোধ শুরু হয়। এই সময়, মীর কাসিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর, বিহারের বক্সার নামক স্থানে মীর কাসিমের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীর সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজেরা জয়লাভ করে। মীর কাসিমের দুর্বল সামরিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা কারণে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়।

বক্সারের যুদ্ধের কারণ

বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বক্সারের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। নিম্মে বক্সারের যুদ্ধের প্রকৃত কারণসমূহ বর্ণনা করা হল।
১. রাজস্ব সংস্কার: মীর কাসিম বাংলার আর্থিক শক্তি ও রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের জন্য কিছু কঠোর নীতি নেন। যেমন, নবাবী দরবারের ব্যয় সংকোচন করেন।
২. রাজধানী স্থানান্তর: বাংলার রাজধানী মুরশিদাবাদ কলকাতার খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায়, ইংরেজরা নবাবের কাজে প্রায় সময় হস্তক্ষেপ করত। মীর কাসিম ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত এবং স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার উদ্দেশ্যে তাঁর রাজধানী মুরশিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। এতে ইংরেজরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়।
৩. নবাবী ফরমান লাভ: মীর কাশিম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে নবাবী ফরমান লাভ করেন। কোম্পানী মোগল সম্রাটের ওপর তাঁর নির্ভরতা মেনে নিতে পারেন নি।
৪. কর্মচারিদের বিতাড়ন: মীর কাশিম লক্ষ্য করেন যে, তাঁর বিভিন্ন কর্মচারী ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই সব কর্মচারিদের তিনি বিতাড়িত করেন। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারিদের বরখাস্ত করেন বা তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।
৫. বিনাশুল্কে বাণিজ্য বন্ধ: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলায় বিনাশুল্কে ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার বা সনদ লাভ করে। কিন্তু কোম্পানি ও তার কর্মচারিরা এটির চরম অপব্যবহার করে। ফলে, নবাব বিপুল পরিমাণ শুল্ক থেকে বঞ্চিত হয়। তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসায় নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। তিনি সব বণিকের পণ্যদ্রব্যের ওপর হতে শুল্ক রহিত করে দেন। ফলস্বরুপ, বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া ও বিশেষ সুবিধা নষ্ট হয়ে যায়।
৬. ইংরেজদের প্রাধানামুক্ত হওয়া: মীর কাসিম ছিলেন অনেকটা স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি কারো হুকুম এবং করায়ত্তে থাকতে পছন্দ করতেন না।

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল ছিল সূদুর প্রসারী। এই যুদ্ধের পরে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাট পরিবর্তন আসে।
  • বক্সারের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীন নবাবীর অবসান ঘটে এবং ইংরেজদের আধিপত্য এলাহাবাদ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বাংলা থেকে দিল্লি পর্যন্ত অর্থাৎ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়।
  • ইংরেজরা উত্তর ভারতে বিরাট শক্তিতে পরিণত হয় এবং বাংলায় চুড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
  • ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
  • মিরজাফরকে দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলার নবাব হিসেবে ঘোষণা করে। নবাবের সকল সামারিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পুতুল সরকারে পরিণত করে।
  • মীরজাফর সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মেদিনীপুর, বর্ধমান ও চট্টগ্রাম ইংরেজদের হাতে তুলে দেন।
  • লবণের উপর দুই শতাংশ শুল্ক ব্যতীত ইংরেজদের বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়।
  • এলাহাবাদের চুক্তিতে ক্লাইভ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা করেন।
  • অর্থনীতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর, কোম্পানির কর্মচারিরা বাংলায় শোষণ ও লুণ্ঠন শুরু করে।
  • দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি আদায়ের অধিকার লাভ করে। এর ফলে কোম্পানির রাজস্ব আদায়ে আইনগত বৈধতা পায়।
5/5 - (17 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x